বাক্‌ ১৫০ ।। ফিনেগানস ওয়েক ।। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য


 


আদিতে ছিলাম আমরা চারজনমালদোরর, লত্রেমো, আমি আর ঈশ্বর।

মালদোরর যখন অক্টোপাস হয়ে ঈশ্বরকে খেতে যাচ্ছিলো, তখন লত্রেমো তার প্রাণ আর আমি তার হৃৎপিণ্ড হয়ে ছিলাম। তার তখন তিন তিনটা হৃৎপিণ্ড। সে গাইছিলো ঘুমপাড়ানিয়া গান, যেন শয়তান-ঈশ্বরটা ঘুমিয়ে পড়লেই সে তাকে সমস্ত খেয়ে ফেলতে পারে। তার বুকের ভিতর আমি ধুকপুক ধুকপুক করে বাজিয়ে যাচ্ছিলাম অবিরাম তিন তারের হৃদয়।

আমরা তিনজনে মিলে ভেবেছিলাম এইভাবে ব্রহ্মাণ্ড বদমাশ ঈশ্বরের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করবো। কিন্তু লত্রেমো মরে গেলো হঠাৎ। আর ব্রহ্মাণ্ডে শুরু হয়ে গেলো ঈশ্বরের শয়তানি।


দেবযানী বললো, ‘কচ! সময় ভালো না। ছাতে যে খেলার মাঠ আছে ওইখানে রোদে রোদে হেঁটে আসো।
কচ ছাতে গিয়ে হ্যামকে শুয়ে থাকে সূর্যমুখী হয়ে। হাঁটতে ভালো লাগে না তার। আর দেখে সারি সারি দোলনায় শুকোচ্ছে নবজাতকেরা। কচের মনে পড়ে যায় বহুদূর ফেলে আসা সমুদ্রপাড়ের শুটকিপল্লির স্মৃতি। আর শিশুদের গালে গলে পড়ছে রূপবতী সূর্য। কচের মন করলো দেবযানীর গর্ভে জন্ম নিতে আবার। ফলে কচ মনে মনে পিতা বৃহষ্পতিকে স্মরণ করলো।
বৃহষ্পতি উপস্থিত হলে কচ তার কাছে বর চাইলো। বৃহষ্পতি তাকে বললো, ‘এর আগে একবার তোমাকে কৌশিক হয়ে জন্ম নিতে হবে। তারপর শনির বলয়ে পা ঝুলিয়ে বসে সূর্যকে তিনবার তিরস্কার করতে হবে। পৃথিবীকে দশবার ধ্বংস করে আরো তিনবার বানাতে হবে।
কচ বললো, ‘পারবো না। তার চেয়ে ছবি আঁকা ভালো। ছবির মধ্যেই আমি দেবযানীর গর্ভে উদ্গত হবো।


আমকাঠের আগুন বিক্রি হবে। কারো যদি লাগে নিয়ে যেতে পারেন। যার যতটা দরকার আগুন লেলিহান হওয়ার আগেই নিয়ে যাবেন। সাক্ষাতেই হবে যথাযথ মূল্য নিরূপণ।

আমকাঠের আগুনের রং সুন্দর। তাপে আর উত্তাপে সূর্যের ভাই। ধীরে ধীরে জ্বলে, ধীরেই নেভে। ছড়ায় ভালো, পোড়ায়ও তেমন।

১০৩ ডিগ্রি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছেন, রাত্রিটাকে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছেন বিছানায় তবু মনে হচ্ছে হিমালয় আপনাকে জড়িয়ে নিচ্ছে নিরন্তর। আপনি তখন আমকাঠের আগুনে পোহাবেন জ্বর, আর আগুনে পুড়ে যাবে এক জীবনের সকল কহর।


মার্লোর দুই চোখ হোরাসের চোখের মতো। এক চোখে সূর্য, অন্য চোখে চন্দ্র। একই বছর মার্লো আর শেক্সপিয়রের জন্ম হয়। মাস ভিন্ন হলেও তারিখ একই, ছাব্বিশ। মার্লো শেক্সপিয়রের চেয়ে কয়েক মাসের বড় ছিলো বয়সে। তারা কৈশোরেই পরস্পরের প্রেমে পড়ে। আর ঘোড়ার মতো দৌড়াতে থাকে পাশাপাশি। আর অমিত্রাক্ষর ছন্দে নাটক লিখতে শেখায়। দিন যায়, মাস যায় বছর যায়। প্রেম চিন্ময় রাক্ষস হয়ে চুপ করে থাকে। প্রেমের এক পর্যায়ে মদ খাওয়ার পয়সা যোগাতে মার্লো তার আত্মা বিক্রি করে দেয় শয়তানের কাছে। আর যিশু আর তার পিতাকে মাঝরাস্তায় পায়ে পিষে মেরে ফেলে চুরুটের লেজের সঙ্গে।

আত্মারহিত মার্লোর শরীর ছাড়া আর কিছু নাই। আশ্লেষে চুমু খায় না আর। শেক্সপিয়র এই অবহেলা মানতে পারে না। মার্লোর প্রতিভার ধারও সহ্য করতে পারে না, ঈর্ষায় খাক হয়।

মার্লোর উনতিরিশ যে-বছর পূর্ণ হয় একদিন এক মদের ঠেক-এ সে মাতাল হয়ে যায়। সকলকে ধরে ধরে বাপান্ত করে। আর দুইজন মুখোশধারী দুইপাশ থেকে এসে মার্লোর গলা কেটে দেয় ছুরি দিয়ে। তৃতীয় মুখোশধারী আসে, তার হাতে একটা হিরণ্ময় ছুরি। সে ছুরির ফলায় মার্লোর দুই চোখ তুলে একটা ছোট্ট কাচের বয়ামে নেয়। তারপর ওভারকোটের পকেটে পুরে নেয়। তারপর ঠেক থেকে বের হয়ে ছুরি আর মুখোশ ফেলে দেয় কালো একটা নর্দমায়। তারপর নিজের ঘরে চলে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দুই চোখের উপর চাপ দিয়ে বসিয়ে মার্লোর দুই চোখ। তারপর সেই চোখে দেখে নেয় দৃশ্যান্তর, রোদ আর জোছনার। তারপর চোখের আলোয় সেই বছরই লিখে ফেলে সেই কবিতা, ভেনাস আর অ্যাডোনিসের প্রেম গান। খুনির চোখে জ্বলছে তখন অ্যাডোনিসের দুই চোখ।


নিৎশের চোখ খুলে একদিন কুয়ার মধ্যে পড়ে গেলো। ঘটনাটা এমন, তার নারীটি তাকে ছেড়ে যাওয়ার পর সে আধাপাগল হয়ে গেলো। মুখভর্তি দাড়ি হলো, মাথার চুল প্রায় পড়ে গেলো, বানরের লেজ যেমত গোঁফ হলো। তার আয়নাটা ভেঙে যাওয়ার পর সে নতুন আয়না নিলো না আর। ভাবলো কী দরকার নিজের মুখ দেখে! একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় জনহীন একটা শহরতলীর রাস্তার ধারে একটা পাতকুয়া দেখতে পেলো। সে কুয়ার পাড় ধরে দাঁড়িয়ে দেখলো অনতিনিচে টলটলে কালোজল। জল আসলে কালো নয়, তার কালো চোখের ছায়া পড়েছিলো সেই জলে। তখন তির তির করে কাঁপছিলো জল, কারণ হবে হয়ত খানিক আগে কেউ জল তুলে নিয়ে গেছে ঘরের কাজে, সেই সময়ের কম্পন ধরে জল তখনো হয়নি আয়নার শরীর। যবে হলো নিৎশে নিজের মুখ দেখতে পেলো। দেখলো সে আরো রূপবান। তারপর হাতের চেটোয় একটু চোখ ঘষলো আনন্দে। আর দুটো চোখ খুলে পড়ে গেলো কুয়ায়।

নিৎশের চোখের জলের আয়নায় সেদিন থেকে আকাশের তারারা পড়ে থাকে কোনো কোনো রাতে। আর তারার গায়ের পঞ্চকাঁটায় বিঁধে থাকে ঈশ্বরের প্রাণ, তারা ঈশ্বরকে হত্যা করে ঝরে পড়ে তার চোখের কুয়ায়।


এমন সাধারণ রাতে আমি তার দরজা ধাক্কাই। সে দরজা খুলে দাঁড়ায়। তার গায়ে জড়ানো থাকে ঘোর অন্ধকার। আমি অস্ফটে বলি, ‘পানি খাবো।
সে গ্লাসভর্তি করে পানি এনে দেয়। আমি গ্লাস খালি করে ফেলি মুহূর্তেই, দীর্ঘ এক চুমুকে। আর বলি, ‘পানি খাবো।
সে পানি এনে দেয়। আমি বোতল খালি করি। তৃষ্ণা যায় না। আরো বাড়ে। বাড়তে বাড়তে ফুলে ওঠে। সে আরো পানি এনে দেয়। আমি পানির ফিল্টার কাত করে গলায় ঢেলে দিই।
পানি খাবো।
সে পানির কলের মুখে লাগানো একটা পাইপ এনে আমার মুখে দেয়। আমি ছাতের দিঘলব্যাপ্ত জলাধার খালি করে বলি, ‘পানি খাবো।
সে ওয়াসার লাইন থেকে একটা নল এনে আমাকে দেয়। আমি শহরের সমস্ত পানি খেয়ে শেষ করে ফেলি। নদীর দিকে যাবো কিনা ভাবি। ততক্ষণে শহরের রাস্তায় আর্মি নেমেছে। নদীর পাড়ে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে। ভয়াল সব বন্দুক তাক করে আছে অদৃশ্য শত্রুর দিকে।

তৃষ্ণায় আমার প্রাণ গলায় আটকে আছে। আমি খুঁজছি আরো জলাধার। আরো লাবণ্যরহিত সমুদ্র, আরো নদী ও কল্লোল। দোকানপাট, সুপারমার্কেট সব বন্ধ। নালা-নর্দমা শুকিয়ে চেলাকাঠ। চাঁদের গায়ে লেগেছে নতুন কলঙ্ক, হলুদ হয়ে গলে পড়ছে রাস্তায়। আমি ঘুরছি, পা আটকে যাচ্ছে গলে পড়া চাঁদের পাঁকে। কোথাও পানি নাই, কোথাও জল নাই। যেন বা সাফা-মারওয়ায় আমিও খেলছি সপ্তপদী খেলাÍপদাঘাতে জন্মে দেবো অনন্ত নহর।

আমি ঘুরে ঘুরে তার দরজায় টোকা দিই আবার। সে দরজা খুলে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেয়। তার পরনে দেখি বিশদ জোছনা। আমি বলি, ‘পানি খাবো।
এইবার সে নিজের হাতের শিরা কেটে দেয়।


আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে ভাবছি, ‘আমার কিছু হবে না, আমি মরবো না।কিংবা ভাবছি, ‘বেঁচে থাকলে ফলের বাগান করবো, সবজি চাষ করবো, ধান লাগাবো, সন্তানের জন্ম দেবো, আইসক্রিম খাবো, আবার শীতের সন্ধ্যায় জিএনজি অটোরিকশায় বসে আশ্লেষে চুমু খাবো, আবার টানা ছয়দিন কোহেন বা পিংক ফ্লয়েড শুনবো, শুনবো শিবকুমার শর্মার সন্তুর, তিনতালে কৌশিকধ্বনি কিংবা দুটো প্রেম করবো কিংবা বারান্দার টবে লাগাবো একটি কুঞ্জলতা... কিংবা...

কিন্তু এইসব দিনরাত্রি বড়ই অচেনা। কোনো বাঁচিয়ে চলাই নিরাপদ নয়। তবু বিলাসের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলছি না আর, নিশ্বাস জমিয়ে রাখছি কিছু। শ্বাসকষ্টের রাত্রি এলে, নক্ষত্রের সেই রুপালি আগুনভরা রাতে জমানো নিশ্বাস খরচ করে চোখে নেবো প্রিয়তম মুখগুলি। তারপর তারা হয়ে যাবো।

আমি স্বাতি তারা হবো। তুমি কোন তারা হতে চাও? বলো।


নদীরা আদি পাহাড়ের বিবর থেকে কাউকে এই সমুদ্রের ফেনায় ফিরিয়ে আনবে। ফেনাগুলি সাপ হয়ে ফণা তুলে তাকে আশ্লেষে বানিয়ে দেবে টকটকে লাল। সূর্য ম্লান হলে পবিত্র সাপগুলি তার পদমূলে জ্বলে হবে শিশ্নিত সকাল।

শশী: তোমাকে যদি একটা নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসার আগে তিনটে বই নিতে বলা হয় কোন তিনটে নেবে?
আমি: মহাভারত, গীতবিতান আর জীবনদাশের কবিতা।
শশী: তিনটেই কবিতা?
আমি: হয়।

আর শশী খুন হয়। সে খুন হতেই আমার মাথার ভিতর জেগে উঠলো ফিনেগানস ওয়েক। আমি আসলে নিয়ে যেতাম ফিনেগানস ওয়েক।

জয়েস: সমালোচকদের তিনশো বছর ব্যস্ত রাখার জন্যে আমি এই বই লিখেছি।
আমি: আর পাঠকদের?
জয়েস: একটা জীবন।
আমি: খেলবো না। তোমার এই ছেলেখেলায় আমি নাই, আমি নাই। আমি নিজেই খেলা বানাই।
জয়েস: হয়।

আর জয়েস খুন হয়। সে খুন হতেই আমার মনে হলো সেই দ্বীপে আমি আসলে কিছুই নিয়ে যেতাম না নিজের শরীর ছাড়া। এমনকি ছায়াটাকেও রেখে যেতাম এই ক্লেদাক্ত পরিচয়তলে। আর সেই দ্বীপেই অক্লেশে প্রথমে বানিয়ে নিতাম নিজের একটি ছায়া। নিজের সাপ থেকে বানিয়ে নিতাম নদী, সমুদ্রের ফেনা আর সূর্যের রং।

No comments:

Post a Comment