বাক্‌ ১৫০ ।। ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ' ।। রাহুল দাশগুপ্ত


 

 

ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। ওই বছরই লেভ তলস্তয় মারা যান। আন্তন চেকভ মারা গেছেন ১৯০৪ সালে। ম্যাক্সিম গোর্কি এই উপন্যাসটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং চেকভের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে বুনিনকে চিহ্নিত করেন। এই উপন্যাস সম্পর্কে বুনিন নিজে লিখেছেন, ‘আমি গ্রামজীবন নিয়ে কাহিনি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা ছাড়াও আমি সাধারণভাবে রুশ জীবনের ছবিও দেখাতে চেয়েছিলাম।' রাশিয়াকে গভীরভাবে জানতেন বুনিন। এই উপন্যাসে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘গোটা রাশিয়াই আসলে একটা গ্রাম। সারা জীবন একথা মনে রেখো।' দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেকভ বা গোর্কির মতো মহৎ দার্শনিক লেখকেরাও সম্ভবত রুশ মাটির, জনজীবনের এত গভীরে প্রবেশ করতে পারেননি। এদের বেশিরভাগ লেখাই নগরকেন্দ্রিক। বুনিন যেভাবে রাশিয়ার গ্রামকে তুলে এনেছেন, সেখানকার মানুষের বসবাসের স্থান, পোশাক, খাদ্য, অভ্যাস, আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন, তা ছিল রুশ সাহিত্যে এক অভিনব ব্যাপার। বুনিনের গদ্যে কবিতা আর সঙ্গীত মিলেমিশে যায়, এক বিধ্বস্ত, অশান্ত জীবনের ছবি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বিষণ্ণ গীতিময়তায়। এই জন্যই গোর্কি বলেছিলেন, 'ফর মি, ইউ আর এ গ্রেট পোয়েট।'

১৯৩৩ সালে প্রথম রুশ লেখক হিসাবে নোবেল পুরস্কার পান বুনিন। ১৯৩৭ সালে স্তালিন জমানায় ইভান বুনিনকে ‘ক্লাসিক রাশিয়ান রাইটার’ বলে জনসমক্ষে উল্লেখ করার অপরাধে ভারলেম শালামভকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সতেরো বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। মুক্তি পাওয়ার পর শালামভ কিন্তু আলেকসান্দার সলঝেনিৎসিনের সঙ্গে ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’র সহযোগী লেখক হতে রাজি হননি, কারণ, সলঝেনিৎসিনকে তিনি নিজের তুলনায় নিকৃষ্ট লেখক বলে মনে করতেন। সলঝেনিৎসিন অবশ্য শালামভের মহত্বকে স্বীকার করে অকুণ্ঠভাবে লিখেছিলেন, ‘শালামভস এক্সপেরিয়েন্স ইন দ্য ক্যাম্পস ওয়াজ লংগার অ্যাণ্ড মোর বিটার দ্যান মাই ওন’। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, স্তালিনযুগেও ইভান বুনিন কতটা প্রভাবশালী লেখক ছিলেন এবং যদিও তিনি বহুদিন আগেই দেশত্যাগ করেছিলেন তথাপি তাঁর সম্পর্কে তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের কী প্রবল ভীতি ছিল! বুনিনের রচনা যে কতটা সত্যনিষ্ঠ ছিল, তা এই ভীতির পরিমাণ দেখেই বোঝা যায়!

‘দি ভিলেজ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে আছে ১৯০৫ সালের প্রথম রুশ বিপ্লব। তিখন আর কুজমা নামে দুই বয়স্ক ভাইয়ের কাহিনি আছে এতে। দুই ভাই যেন দুই গোলার্ধ, আর এই দু’জনকে নিয়েই গোটা রাশিয়া। এদের পূর্বপুরুষ ছিলেন একজন ভূমিদাস। ১৮৬১ সালে রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা লোপ পায়। তিখন দুরনোভকা নামে জমিদারির মালিক, কুজমা সেই জমিদারির ম্যানেজার। 'দুরনোভকা’ কথাটির অর্থ ‘খারাপ’ বা ‘অশুভ'। তিখন বাস্তববাদী, পরিশ্রমী, বস্তুবাদী, নিষ্ঠুর আর আগ্রাসী। কুজমা ভাবুক, স্বপ্নদ্রষ্টা, পড়ুয়া, শিক্ষিত, হৃদয়বান, সংবেদনশীল। তিখন সারাজীবন প্রেমহীনতায় ভোগে, দরকার হলে জোর করে দখল করে নিতে চায়। কুজমা প্রেমকে নিভৃতে লালন করে, তাকে গভীরে অনুভব করে। দুরনোভকা কোনও সহজ জায়গা নয়, তা হিংসা, অশান্তি ও নিয়মহীনতায় পরিপূর্ণ। এখানে অজ্ঞানতা, ঘৃণা, দারিদ্র্য, নোংরা, নিষ্ঠুরতা, আলস্য নিত্য বিরাজমান। প্রথম রুশ বিপ্লবের সময়কার রাশিয়ার প্রকৃত বাস্তবতা মূর্ত হয়ে উঠেছে এই আখ্যানে। একজন ভূমিদাসের দুই উত্তরপুরুষ, তাদের একজন নিজেই হয়ে উঠেছে সামন্তপ্রভু, অন্যজন মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী, নাগরিক বুদ্ধিজীবী, একজন অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, অন্যজন ভবিষ্যতের, আর এই দুইয়ের সহাবস্থানই গড়ে তুলছে রাশিয়ার তৎকালীন বর্তমানকে।

লেভ তলস্তয় ‘আন্না ক্যারেনিনা’ উপন্যাসে এবং আন্তন চেকভ ‘দি চেরি অর্চার্ড' নাটকে যুগ সন্ধিক্ষণের ছবি এঁকেছেন। দেখিয়েছেন, সামন্তবাদী রাশিয়া কীভাবে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী, শিল্পোন্নত রাশিয়ায় বদলে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কী বদলে যাচ্ছে? সামন্তবাদী সমাজের আসল কাঠামোটি কী একইরকম থেকে যায়নি? যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা শুধুমাত্র বাইরের প্রলেপ, নগরে এবং মুষ্টিমেয় নাগরিকের জীবনে? এই প্রশ্নই যেন এই উপন্যাসে তুলেছেন বুনিন। উপন্যাসের প্রথম পর্বে তিখনের চরিত্রটি ছোটো ছোটো তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। খুবই তীক্ষ্ণ তার স্বভাব। চারপাশের গরিব মানুষকে আস্ত নির্বোধ বলেই সে মনে করে। নিজের কোনও সন্তান নেই তিখনের। সারাজীবন ধরে প্রচুর সম্পত্তি জমিয়েছে সে। কিন্তু এসবই তার কাছে বোঝার মতো মনে হয়। স্ত্রী অসুস্থ, তাকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে সে ক্লান্ত। জীবনটাই তার কাছে অসাড়, অর্থহীন বলে মনে হয়।

দুরনোভকা জায়গাটিও বিষন্ন, ঠাণ্ডা, নোংরা আর অন্ধকার। একজন জীবিত মানুষের সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। প্রতি পাঁচ বছরে এখানে একবার করে দুর্ভিক্ষ হয়। তিখনের দোকানে নানা ধরনের মানুষ আসে। ভিখিরি, ভবঘুরে, ছোটো ব্যবসায়ী, ভাড়াটে মেয়ে, রাতের পাহারাদার, গাড়িচালক, ঠিকে মজুর, নামহীন সব মানুষ। এইসব অভাবী, নিপীড়িত মানুষের মধ্যে রয়েছে যুগ-যুগান্তরের ঐতিহ্য, তাদের মাটির প্রতি সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতা, জীবনের প্রতি ভালোবাসা, বিনীত-অবদমিত স্বভাবকেই তুলে ধরেছেন বুনিন। তিনি যেমন তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেননি, তেমনই তাদের মহৎ করেও দেখাননি, কোনও আবেগ প্রকাশ করেননি তাদের নিয়ে, বরং গভীর ভালোবাসায় তাদের চারপাশের অন্ধকার, হিংসা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও তাদের অপাপবিদ্ধতাকেই দেখিয়েছেন, চারপাশের দুনিয়ার চালাকি ও দুর্নীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বদ্ধ জীবনে তাদের বেঁচে থাকার নিস্পাপতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

এত অভাব, দারিদ্র্য, নীচতা ও ক্ষুদ্রতার মধ্যেও বুনিন কবিতা ও সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, এমনই তাঁর সৌন্দর্যবোধ, বিশেষ করে প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়ার বর্ণনায় তিনি যে কোমল, সূক্ষ্ম, পেলব স্পর্শ দিয়েছেন, তা নিশ্চিতভাবেই মার্সেল প্রুস্তকে মনে করিয়ে দিতে পারে! মেলায় গিয়ে তিখনের চোখ দিয়ে যেন রাশিয়াকেই দেখিয়েছেন তিনি। তিখন গেছে অস্বাস্থ্যকর হাসপাতালে, নোংরা, বিবর্ণ চার্চে আর সমাধিস্থানে। মৃত্যু ও ক্ষয়ের ছবি দেখে আঁতকে উঠেছে। সমাধির গায়ে লেখা শান্তি, প্রেম ও বিশ্রামের কথাগুলো তার কাছে অসত্য বলে মনে হয়েছে। এক বৃদ্ধ মহিলার কাছে রূপকথার গল্প শুনেছে। নারী তীর্থযাত্রী ও মাতাল জনতার মুখোমুখি হয়েছে। চাষিরা নগ্ন ও ক্ষুধার্ত। যাজক অর্থলোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত। চারপাশের দারিদ্র্য দেখে তিখনের মনে হয়েছে, একজন জবরদস্ত মালিকের প্রয়োজন যে সব ঠিক করে দেবে এবং এই দুনিয়ার সবচেয়ে জরুরি বিষয়টি হল, ব্যবসা। এভাবেই পুরনো যুগের সামন্ততান্ত্রিক ও নতুন যুগের পুঁজিবাদী প্রভাব মিলেমিশে গেছে তার মানসিকতায়।

বিপ্লবের খবরে প্রথমে খুশিই হয়েছিল তিখন। কিন্তু বিপ্লবীদের হাতে জমি খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনায় সে ঘোর বিরোধী হয়ে ওঠে। তার মনে হয়, কোথাও কোনও বোঝাপড়া নেই। সবাই বিপ্লব, বিপ্লব বলে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেছে, নিতান্ত সাদামাটা। মানুষের কথায় বা নীরবতায়, সবকিছুতেই বোঝাপড়ার অভাব! পাখির গান, মাটির প্রশান্তি, ফুলের গন্ধ সবকিছুই আগের মতোই আছে। তিখন বিপ্লবীদের জন্য অপেক্ষা করে, তারা এলে গর্জন করে, তার শূন্যে ছোঁড়া গুলি আপেল বাগানে গিয়ে পড়ে, গোটা উয়েজদ জেলায় বিপ্লব ছড়িয়ে যায়, চাষীরা বিভিন্ন জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়, বেশ কয়েকটি জমিদারী দখল করে, জমিদারেরা পালিয়ে গিয়ে সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের আশায় শহরের হোটেলগুলিতে গিয়ে ভিড় করে। বিপ্লবের পর জমিদারদের অবস্থা হয় শোচনীয়। তাদের অনেকেই অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটায়, শেষ সম্বলটুকু বেচে দেয়, ভাঙা জানলা বা ফুটো ছাদ সারাইয়ের অর্থ পর্যন্ত জোটাতে পারে না। অন্যদিকে নতুন একটা শব্দ খুব শোনা যায়। প্রলেতারিয়েত। এদের খাবার জোটে না, এদিকে বই কিনতে ফতুর হয়ে যায়। আর কী সব বই! এ এমন এক দুনিয়া, যেখানে, পকেটে পয়সা থাকলে তবেই তুমি দুনিয়ার মাথায় চড়ে বসতে পারবে।

বিপ্লবের পর সব শান্ত হয়ে গেলে, তিখন আবার বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার জমিদারীতে আশ্রিতা রোদকার স্ত্রী ইভদোকিয়াকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণও করে। কিন্তু বাবা হওয়ার স্বপ্ন তার কাছে অপূর্ণই থেকে যায়। এরপরই তিখন নিজের ভাই কুজমাকে শহর থেকে ডেকে আনে এবং নিজের জমিদারীর ম্যানেজারের ভার দেয়। হতদরিদ্র, রিক্ত, দুর্দশাগ্রস্ত ছবি সেই জমিদারীর। একজন সুস্থ স্ত্রী, উষ্ণ ঘর, হইচই করা সন্তান, এই সমস্ত কিছুর স্বপ্ন চিরকাল স্বপ্ন হয়েই থেকে যায় তিখনের কাছে। নিজের স্ত্রী পর্যন্ত সারাজীবন তার কাছে অচেনাই থেকে যায়, সে কেমন মানুষ কোনওদিন তার খোঁজ নেয় না সে। এখন ঘন ঘন তার মনে আসে শুধু মৃত্যুচিন্তা। আর অতীতের টুকরো টুকরো ঝলমলে স্মৃতি। আত্মহত্যার কথাও মনে হয়। বার্ধক্য ও মৃত্যুর কোনও সান্ত্বনা নেই তার কাছে। সবসময় আত্মকরুণায় ভরে থাকে মন। জীবন খুব দ্রুত কেটে যায়, মানুষ মানুষকে স্রেফ ওপর ওপর চেনে, আর সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি ভুলেও যায়। দশ বছরকে মনে হয় সামান্য কয়েকটা দিন। এই কী জীবন! শান্তি ও স্তব্ধতার মধ্যেও তাই বিষন্নতা ছাড়া আর কিছুই বোধ করে না তিখন।

কাহিনি এবার আবর্তিত হয় কুজমাকে ঘিরে। নিজের দেশ ও মানুষ নিয়ে কুজমার মধ্যেও কোনও মোহ নেই। সে তার ভাইকে স্পষ্ট জানায়, এ দেশের মানুষ বন্য ও বর্বর। তারা শুয়োরের মতো বেঁচে আছে, পচে যাচ্ছে এবং শুয়োরের মতোই বেঁচে থাকবে। এটাই তাদের বেঁচে থাকার রীতি। গোটা দেশের ইতিহাস শুধু খুন আর বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ। এখানে কেউ সারল্য দেখাতে গেলে ডাকাতি করার চেয়েও বেশি অপরাধ করবে। গোটা দুনিয়ায় এরকম দরিদ্র দেশ আর নেই। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে এত ইতর ব্যবহারও দুনিয়ার আর কোনও দেশে করা হয় না। দারিদ্রকে এখানে সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়। তোমার খাওয়ার মতো কিছু না থাকলে তুমি চিন্তা করবে কী করে? গোটা দেশ ভরে গেছে ভিখারি আর বেশ্যায়। এখানে মেয়েরা হাতে রুটি নিয়ে পুরুষের শরীরের নিচে শুয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম রুশ বিপ্লবের সময়কার রাশিয়ার বর্ণনা দেন বুনিন।

কুজমা সারাজীবন শুধু পড়ালেখাই করতে চেয়েছে। তিখনের কাছে জীবন অন্তঃসারশূন্য। কুজমার কাছে জীবন অতি সাধারণ। আর এই সাধারণত্বই তাকে পীড়া দেয় সবসময়। জীবনের এই সাধারণত্ব মানুষের বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয়। এরকম পরিবেশে, দারিদ্র্যে আর অভাবে, মানুষ কুঁকড়ে থাকে সবসময়। কুজমাও কুঁকড়ে গেছে। জীবনের শিক্ষা সে পেয়েছিল বৃদ্ধ অ্যাকর্ডিয়ন বাদক বালাশকিনের কাছে। এই লোকটি ছিল খামখেয়ালি আর মুক্তচিন্তাকে প্রশ্রয় দিত। বালাশকিনই তাকে শিলার আর তুর্গেনেভের 'স্মোক' পড়তে দেয়। তাকে বোঝায় সে এমন এক দেশের বাসিন্দা, যেখানে পুশকিন আর লেরমন্তভ, জাতির চিরশ্রেষ্ঠ দুই কবিকে হত্যা করা হয়েছে। অসামান্য ভাবুক, জর্জ প্লেখানভ এবং লেনিনের গুরু, দিমিত্রি পিসারভ জলে ডুবে মারা গেছে। ডিসেন্ত্রিস্ট বিদ্রোহের নেতা এবং রুশ কবি কনদ্রাতি রিলেয়েভকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, হাতে বায়রনের কবিতার বই নিয়ে তিনি বধ্যভূমিতে যান এবং আবেদন করেন, তাঁর দেশ খুবই অসুখী এবং গোটা বিদ্রোহের জন্য তিনি একাই দায়ী, তাঁকে একাই যেন শাস্তি দেওয়া হয়। দস্তয়েভস্কি ও গোগোল, মহত্তম দুই গদ্যকার, কী পরিণতি হয়েছে তাঁদের? প্রথমজনকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, দ্বিতীয়জনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে উন্মাদ হওয়ার দিকে। ইউক্রেনের জাতীয় কবি তারাস শেভচেঙ্কো আর জারকে যিনি ‘ফাঁসুড়ে’ বলেছিলেন, সেই বিদ্রোহী রুশ কবি আলেকজান্দার পলিঝায়েভের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। দুনিয়ায় এরকম দেশ কী আর একটাও আছে?

রুশ সাহিত্যের বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কুজমার সঙ্গে বালাশকিনের কথাবার্তা হয়। দস্তয়েভস্কির ‘কারামাজভ ব্রাদার্স’ এর কারামাজভ, ইভান গনচারভের ‘ওবলামভ’, লেভ তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পিস’-এর প্লাতোন কারাতায়েভ, ‘কসাক’-এর ইয়েরোশকা, লুকাশকা, গোগোলের ‘দি গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টর’য়ের খেলেশতাকভ, ডেড সোলস’এর নোজদ্রেভ এইরকম। শ্চেদ্রিনের স্যাটায়ার এবং তলস্তয়ের প্রবন্ধ পড়ে কুজমার সময় কাটে আর কেবলই মনে হতে থাকে, জীবনটা কোনও কাজেই এল না, স্রেফ পণ্ডশ্রম করেই কেটে গেল। মৃত্যুর আগে বালাশকিন কুজমাকে পরামর্শ দিয়ে যায়, জীবনের প্রতিটি ঘন্টায় কিছু না কিছু শেখো, কিছু ভাবো, আর চারপাশের দুর্ভাগ্য আর দুর্দশার দিকে তাকিয়ে দেখো। কুজমাকে সর্বক্ষণ পড়াশুনো করতেই দেখা যেত, অভিশপ্ত রুশ জীবনের নানা টুকরো, কখনও জুড়ছে, আবার কখনও বাদ দিচ্ছে। তলস্তয়ের ‘কনফেশন’ পাঠ করে টানা এক বছর কুজমা ধুমপান, ভোদকা পান বা মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। গোগোলের কথা তার মনে পড়ে। কিন্তু জীবনের সাধারণত্ব ভেতরে ভেতরে তাকে তিতিবিরক্ত করে তুলতে থাকে।

ভাই তিখনের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার আগে পর্যন্ত ভবঘুরে জীবনই কাটিয়েছে কুজমা। রাশিয়া ও তার মানুষকে দেখেছে খুব কাছ থেকে। পেটের দায়ে নানা রকম কাজ করতে হয়েছে তাকে। ট্রেনে যেতে যেতে শুনেছে বিপ্লব আর দুর্ভিক্ষের কথা। কুজমার এই ভবঘুরে জীবনের সূত্রে রাশিয়ার খুঁটিনাটি অথচ বৈচিত্র্যপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন বুনিন। দরিদ্র মানুষ এখানে শীতের হাত থেকে বাঁচতে গোবরের স্তুপে নিজের শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থাকে। পনেরো কোপেকের জন্য গরীব চাষী জমিদারের কাছে নিজের স্ত্রীকে বেচে দেয়, যদিও একাজ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কুজমার মনে হয় শহর থেকে গ্রামে এসে রাতারাতি সে বুড়িয়ে গেছে, অসভ্য হয়ে উঠেছে, কয়েকটা দিনকে মনে হয় বহু বছরের সমান। শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব এতটাই। ক্ষুধা ও নানা জটিল চিন্তায় কাতর হয়ে ওঠে সে। শুধুমাত্র বই হয়ে ওঠে তার নিত্য সঙ্গী। রুটির অভাব ছাড়াও মোমবাতির অভাবে বই পড়াও ক্রমে কঠিন হয়ে ওঠে।

দুরনোভকায় আসার পর কিছুটা স্থিতি জোটে কুজমার। খুব কৌতূহলী হয়ে সে এখানকার মানুষদের লক্ষ্য করে। ডাইনি থেকে শুরু করে এমন সব মানুষ এখানে আছে, মনে হয় যারা ওল্ড টেস্টামেন্টের পাতা থেকে উঠে এসেছে। এখানে অভাব আর দারিদ্র্য ভয়াবহ। ঘরে ঘরে উপযুক্ত আলো, জ্বালানি আর খাদ্যের অভাব। সঙ্গে আছে বৃষ্টি, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস আর তুষারঝড়। তার সঙ্গে বসন্ত, জ্বর, কলেরা ইত্যাদি নানা রোগব্যাধি, চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা ছাড়াই। নতুন শস্য তোলার পরও চাষীর ঘরে পর্যাপ্ত রুটি থাকে না। এখানে লোকে বিশ্বাস করে, জার আদ্যন্ত সোনা দিয়ে তৈরি। কিন্তু এই দারিদ্র্যেও কুজমার সংবেদনশীলতা অটুট থাকে। চারপাশের স্তব্ধতার ভেতর সে শুনতে পায় গাছ থেকে আপেল ঝরে পড়ছে।

         দুরনোভকায় এসেই সেরি আর তার ছেলে দেনিসকার সঙ্গে আলাপ হয় কুজমার। সেরির ঘরটা মনে হয় যেন মৃত, শীতল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই অন্ধকার কুজমাকে ভারাক্রান্ত করে। রোদকার মৃত্যুর পর ইভদোকিয়া পুরোপুরি কুজমার আশ্রয়ে আসে। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েটির নিরুত্তাপ আচরণ সবারই বিস্ময় উদ্রেক করে। ইতিমধ্যে আরও একবার তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়, কিছু বাইরের লোক আপেল বাগানে এই চেষ্টা করে। ইভদোকিয়াকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে কুজমা। কিন্তু ইভদোকিয়া মনে মনে কুজমাকে ভালোবাসে। কুজমার উদার হৃদয়ের জন্য কাঙাল সে। রোদকা থেকে কুজমার ভাই তিখন, সারা জীবন তাকে সবাই ভোগ করে এসেছে, কেউ ভালোবাসা দেয়নি। একমাত্র কুজমার কাছ থেকেই জীবনে সে প্রথম ভালোবাসা পেয়েছে। প্রতিদানে কুজমাকেও সে ভালোবাসা দিতে চায়। কিন্তু কুজমা তার মন বুঝতে অক্ষম। মেয়েটিকে নিজের কন্যার মতোই মনে করে সে। আর এই কারণেই কুজমার প্রতি মনে মনে কঠিন হয়ে ওঠে ইভদোকিয়া।

         ভাই কুজমার প্রতি ইভদোকিয়ার এই মনোভাব গোপন থাকে না তিখনের কাছে। ভাইকে দেখে মেয়েটি যেভাবে লজ্জা পায়, তাই তার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। এই মেয়েটিকে একদিন সে ভোগ করেছে। কিন্তু বিনিময়ে সন্তান বা ভালোবাসা কোনওটাই পায়নি। মেয়েটির প্রতি বদলা নিতেই তিখন যেন তাকে দেনিসকার হাতে তুলে দেয়। বদলা, কারণ তিখন মনে মনে দেনিসকাকে ঘৃণা করে। অথচ সেই ঘৃণ্য মানুষটির হাতেই বাকি জীবনের জন্য মেয়েটিকে তুলে দেয় সে। কুজমা এই বিয়ে ঠেকাবার অনেক চেষ্টা করে। ইভদোকিয়া ওপর ওপর কুজমার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখায়। কুজমার জ্বরের সময় যখন সে মেয়েটির কাছ থেকে সহানুভূতি আশা করে, মেয়েটি তখন বিরূপতা দেখিয়ে সরে থাকে। তার এই ব্যবহার কুজমাকে খুবই বিস্মিত করে। কুজমার প্রতি বদলা নিতেই মেয়েটি যেন বিয়েতে রাজি হয়, কারণ হিসাবে জানায়, ভিখারির মতো লোকের দোরে দোরে ভিক্ষা চেয়ে বাকি জীবন সে কাটাতে পারবে না, নিজের নিরাপত্তার কারণেই সে এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। কিন্তু বিয়ের সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মেয়েটি। তাকে বিদায় দিতে গিয়ে কুজমা ভেঙে পড়ে, চোখের জলে ভাসিয়ে দেয়। মেয়েটি ভয়ানকভাবে কাঁপতে থাকে। সে বুঝতে পারে, আবারও একটি পুরুষের ভোগের শিকার হতে চলেছে সে। জীবনে একমাত্র যে মানুষটি তাকে ভালোবেসেছিল, তার সঙ্গে চিরবিদায়ের মুহূর্ত আসন্ন।

         ইভদোকিয়ার বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জমিদারীর ওপর থেকে সব টান চলে যায় তিখনের। বহুদিনের চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়, দুরনোভকা বিক্রি হয়ে যায়। কুজমা ফিরে যায় শহরে, যে শহর তার কাছে আসল দুনিয়া, মানুষ, খবর আর খবরের কাগজে ভর্তি। যদিও নতুন যে রাশিয়া আসছে তার প্রতি কোনই আস্থা নেই কুজমার। দেনিসকা যেন এই নতুন রাশিয়ারই প্রতীক। ব্র্যাণ্ড নিউ টাইপ। পুরনো রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি চতুর ও কৌশলী। কুজমার মনে হয়, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সব বোধই তার গুলিয়ে গেছে। কোনও কিছুই সে ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে না মানুষকে করুণা করা উচিত না ঘৃণা! মানুষের প্রতি কোনও আস্থা নেই তিখনেরও। সে তাই বলে, মানুষ হলো অলস, বাজে বকে, নির্লজ্জ মিথ্যাবাদী, কেউ কাউকে ভেতর থেকে বিশ্বাস করে না, সবাই ওরা একরকম। নিজেকে একটা চেনে বাঁধা শিকারী কুকুর মনে হয় তিখনের। সোনার খাঁচায় বন্দী। কারও প্রতি করুণা নেই তার। তাকেও সবাই ঘৃণা করে। জীবনটা আসলে একটা ছায়া, একটা স্বপ্ন। লোভ আর নির্বুদ্ধিতায় ভরা। জীবনে যা কিছু মূল্যবান মনে হয়, সবই আসলে বাজে ব্যাপার। অসার দম্ভই তাদের মূল্যবান করে তোলে।

         এই উপন্যাস শেষ হয় প্রবল, প্রচণ্ড তুষারপাতের মধ্যে। মৃত্যু ও প্রেম, এই দু'টি বিষয় বারবার বুনিনের লেখায় ফিরে ফিরে আসে। প্রেমের কাহিনি রচনায় রুশ লেখকেরা গোটা বিশ্বে অতুলনীয়। বুনিনও কোনও ব্যতিক্রম নন। ‘দি ভিলেজ’ও আসলে একটি অনবদ্য প্রেমের কাহিনি। দুই ভাই ও একটি মেয়ে। এক ভাই মেয়েটিকে ভোগ করে, অপর ভাই স্নেহ করে। যে ভোগ করে তার প্রতি মেয়েটি উদাসীন, যে স্নেহ করে তাকে ভালোবাসে। শেষপর্যন্ত মেয়েটির ভাগ্যের কোনও বদল হয় না। প্রবল দুর্যোগের মতো মেয়েটির ভাগ্যও বিপর্যস্ত হতে থাকে। দুই ভাইয়ের জীবনেও একাকিত্ব ছাড়া আর কিছুই জোটে না। সারা জীবন ক্ষমতা ভোগ করে, প্রবল দাপুটে তিখন শেষপর্যন্ত আত্মিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়, হতাশা ও শূন্যতায় মৃত্যুচিন্তা তাকে গ্রাস করে, সন্তান ও সুখী পরিবারের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় সারা জীবন। ক্ষমতাহীন ও মেধাবী কুজমা ভোগে প্রেমহীনতায়, গভীর বিষাদে আক্রান্ত হয় সে, সম্পূর্ণ একা হয়ে আবার শহরে ফেরে সে।

          এই দুই ভাইয়ের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও তার মানুষের গভীর দুর্দশার ছবি দেখিয়েছেন বুনিন। গ্রামের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার আত্মাকেই স্পর্শ করতে চেয়েছেন তিনি এবং সেখানে নৈরাশ্য ছাড়া আর কিছুই টের পাননি। রাশিয়ার মহৎ স্রষ্টারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবিক সাহিত্য রচনা করেছেন। আবার সেই রাশিয়াতেই জারের আমল থেকে স্তালিনের আমল পর্যন্ত মানুষের ওপর ভয়াবহ দমন, পীড়ন, অত্যাচার চালানো হয়েছে। এটা ভাবলে অবাকই লাগে, যে রাশিয়ায় তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেকভ, গোর্কি প্রমুখ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার ও সহমর্মিতার শাশ্বত, মানবিক ছবি এঁকে গিয়েছেন, সেখানেই স্তালিন যুগে ১৯২৪-৫৩ সময়কালে শুধু রাজনৈতিকভাবে হত্যা করা হয়েছে প্রায় ২ কোটি মানুষকে। একই দেশে এই ভয়াবহ বৈপরীত্য দেখলে অবাক হতে হয়। স্তালিন যুগে যে হিংসা সর্বগ্রাসী আকার নিয়েছিল, তার গোড়া প্রোথিত ছিল রাশিয়ার জনজীবনের মধ্যেই।

         অভাব, দারিদ্র্য, দুর্দশা, নৈরাশ্যে পীড়িত রাশিয়ার জনজীবনের সঙ্গে হিংসা ও বিশৃঙ্খলা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। বুনিনের গ্রামই আসল রাশিয়া। সেই আসল রাশিয়াকে সত্যনিষ্ঠা ও বাস্তববোধের সাহায্যে এক মহৎ শিল্পীর নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। দস্তয়েভস্কি ও তলস্তয়ের মতো কোনও ইউটোপিয়াকে প্রশ্রয় দেননি, যেখানে জীবনের মহৎ, দার্শনিক সত্যগুলি উঠে এলেও রাশিয়া হয়ে উঠেছে এক সর্বজনীন পরিসর, ওই দেশের খাঁটি বাস্তবতা সেখানে তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গোড়া শুদ্ধ উঠে আসেনি, অন্তত যেভাবে উঠে এসেছে বুনিনের প্রকৃত পূর্বসূরি লেসকভ বা শ্চেদ্রিনের রচনায়!

 

 

 

 


1 comment:

  1. ইভান বুনিনের ‘দি ভিলেজ' এর মধ্যে দিয়ে একটা সময়ের জনজীবনকে উপলব্ধি করতে পারছি। খুব সহজভাবেই লেখাটি বোধগম্য হলো।

    ReplyDelete