বাক্‌ ১৫০ ।। ও রাণাদা,আমি নিজের কবরটা খুঁজছি.... ।। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

১।

টবি।তুই চলে গেলি।পৃথিবীতে একজন ছিল যে আমার গান শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত।আমার কবিতা শুনে তার ঈর্ষা হতো না।এক জোড়া চোখ সহস্র মানবনেত্র মাত করে দিতে পারত।সেখানে স্কোয়ার ফিটের হিসেব নেই।হা হুতাশ নেই।তুই শুনতিস সব।শয়নমুদ্রায়।আমি তোকে আমার ইঁটপাতা রাস্তার কথা বলতাম।রাজকৃষ্ণ পাল লেন।তুই সেসব দেখিসনি।সরু খালপাড়ের রাস্তা।সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝিঁ ডাকে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে।আমি সেই রাস্তা বেয়ে আমার পেটরোগা সাইকেল চালিয়ে ফিরতাম।মোড়ের মাথায় একটা লোক দাঁড়িয়ে থাকত।চোখে কালো চশমা।বুক ঢিবঢিব করত আমার।লোকটা স্টোনম্যান না তো?কী চওড়া পাঞ্জা মাইরি।রাত বিরেতে নির্ঘাত ফুটপাতে পাথর ঝেড়ে মাথা ফাটিয়ে আসে।লোকটাকে রোজ কোচিংফেরত রাস্তার মোড়ে দেখতে পেতাম।একবার কাটাতে গিয়ে সাইকেলের চেন পড়ে গেল।ওরে মা কালী আমার।কী হবে।লোকটা যে আমার দিকেই আসছে।শুনেছি পাশের পাড়ায় দুটো ছেলে ভ্যানিস হয়ে গেছে গত সপ্তাহে।আরবে মা বলেছে ওদের নাকি উটের পেটে বেঁধে রাখে।যতো ভয় পায় ততো কাঁদে।যতো কাঁদে ততো লাথি মারে।যতো লাথি মারে,ততো জোরে চলে উট।আমার যে পায়ে ওটুক জোর ছিল না রে।আর ওই মরণদশা চেন।সামনের কাঁটায় লাগাই তো পিছনেরটা পড়ে।পিছনেরটা লাগাই তো সামনের।বুক ঢিবঢিব বেড়ে যায়।এগারো ক্লাসের পদার্থবিদ্যা মাথায় ওঠে।লোকটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।মোড়ের পেটপাতলা ল্যাম্পফোস্টের চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হেলমেট পরে দাঁত কেলাচ্ছে।মন বলে ওঠে।লোকটা 'হোমো' নয় তো?পবিত্র বলছিল ওকে একবার এরকম একজন ধরেছিল যাদবপুরে।সন্ধ্যাবেলা ঘাপটি মেরে বসেছিল।পটাং করে বেরিয়ে এসে বলেছিল,"কী সোনা?ভিডিও গেম খেলবে?"পবিত্র স্কুলের ফ্ল্যাট চারশো মিটার চাম্পিয়ন।ও পেরেছিল।আমি কীকরে পারবো?হেস্টিংসে হিটস এ গাছতলায় বসে ছবি আঁকি।পায়ে ক্র্যাম্প ধরে যায় পঁচিশ মিটারেই।সময় ঘনিয়ে এলো রে পবিত্র।

-এতো তাড়াহুড়ো করতাসো ক্যান।দাঁড়াও।লাগায়ে দিতাসি।

চারশো চল্লিশ ভোল্ট।ছোঁয়া মাত্র ছাই।মৃত্যু।লোকটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে।যদিও বলার অ্যাকসেন্টে ময়মনসিংহর টান।ও টান আমি চিনি।আমার ঠাকুমা ময়মনসিংহের মেয়ে ছিলেন।কিন্তু ময়মনসিংহতে 'হোমো' নেই,একথা জোর দিয়ে কে কবে বলেছে?ছিটকে যাচ্ছিলাম বিশ্বাস কর।নেহাত সাইকেলটার জন্য।'অ্যাভন'।বড়মামার দেওয়া।

-চেন লাগায়ে দিলাম।বাড়ি যা গে।

লোকটা হাসছে।দাঁতে পান লেগে।ছ্যাতলা পড়ে গেছে।ওয়াক।থুঃ।কিন্তু চেনটা লেগে গেছে।নড়ছে না।

-আমার মাইয়াডাও আসে এই পথে।তাই দাঁড়ায়ে থাকি।তোমারে দেখি রোজ ফিরতি।

-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

হো হো করে হাসে লোকটা।টবি।তোকে ছাড়া কাকে বলব এসব কথা।আমি কী করতে পড়ে আছি এখনও ওখানে।মরণ হয় না আমার কেন?

-স্যার কারে কও?আমারে 'রাণাদা' কইও।আমার দোকান আসে হালতুতে।হার্ডওয়্যারের।চেন এনে দিমু।পালটায়ে নিও।

হন হন করে চলে এসেছিলাম সেদিন।জানিস টবি।ভয় করছিল।আবার করছিল নাও।ভয়ের সঙ্গে একটা দোস্তি হয়ে গিয়েছিল।মন নিশ্চিত হয়েছিল।ওই লোকটা স্টোনম্যান নয়।'হোমো' নয়।লোকটা ভালো।তোর যেমন এখন হচ্ছে?বল দেখি।চুপ করে আছিস যে বড়।ওই যে তোর চারপাশে ওরা সবাই শুয়ে আছে।ওই যে তোর পাশে 'গুড্ডি'।আর তোর নিচেই 'কপার'।আমরা চলে গেলে খুব করে খেলবি নাহয়।খেলিস।তোর মতো আমার একটুকু মাটি চাই।দিবি?বল?দিলে ওই হাড়টা দেব?ক্যালসিয়াম ওয়ালা.....

 

 

২।

টবি।যা বুঝলাম বুঝলি,এই যে এতো সব লেখালিখি কামড়াকামড়ি।সব ফালতু।ইঁদুরদের কারবার।বড় ইঁদুর বনাম মেজো ইঁদুর।তারপর ছোট।প্রত্যেকের নিজস্ব লবি আছে জানিস?নিজস্ব পদক আছে।কবরে যাবার আগে নিজেরাই নিজেরটা খোঁড়ে।তারপর ঘাড় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে।শোবার আগে গলায় পদকটা পড়ে নেয়।ভাবে তুতানখামেনের মতো দু হাজার বছর পরেও লালটুশ হয়ে থাকবে।এদিকে উপরে চুন পড়ে,লবন পড়ে।মাস চারেক ঘুরতেই দাঁত ক্যালানে কঙ্কাল।কী ভেবেছিল কী হলো।এতো পদক।এতো সীলমোহর।সব যে কোথায় ঢুকে গেল। বের হতেই চায় না!

      রাণাদার মতো আরেক রাণাদা আছে।সোদপুরের রাণাদা।খড়দার রাণাদা।আসলে রাণাদা ঠিক সোদপুর না খড়দা।না টিটাগড়।মনে আসে না কিছুতেই।কী করে আসবে বল দেখি টবি?সারাদিন কলম পিষছি।তোকে বলছি।পরিবারের আর কারোকে বলিস না।আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে কবিতা না লেখার জন্য গালমন্দ করেনি।গল্প না লিখলে খিস্তি মারেনি জানিস।কিন্তু ওই কলম আর প্রেসক্রিপশন।কতো ওষুধ লিখব বল দেখি?এতো 'মানসিক' মানবিক মাড়িয়েও মনোবিজ্ঞান হলো পাগলদের চিকিৎসা।একটা ঔপনিবেশিক অর্ধশিক্ষিত মানুষের দেশকে যারা শিক্ষিত হবার শক্তিতে বিশ্বের দরবারে পৌছোতে পারত,তারা পুঁজিবাদের দালাল বনে বিজনেস শুরু করে দিল।তা বলে আমাকে পেচো কমিউনিস্ট ভাবিস না টবি।তুই তো জানিস।আমি ঘোর কালী ভক্ত।ঠাকুর মানি।আল্লা মানি।এক ওঙকার মানি।বড়দিন মানি।মা কালী,থুড়ি।সে যাই হোক।মানি।যে আন্দোলন ছোট ছোট নাবালক নাবালিকাকে বিপ্লবের নামে বেসমেন্টে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে,তাকে আমি ঘৃণা করি।আমার দেশে আমি তিন পয়সার পৈতে ধারী ব্রাহ্মণ।না আছে মন্ত্রর জোর,না সংরক্ষণের।বলতে গেলেই নীচের মণ্ডলবাবু তেড়ে আসেন।'ভালোই তো দিলেন আপনারা বামুনরা।আপনাদের জন্যই তো দেশের এই হাল।'যাহ শালা।আমি কী করলাম?ঠাকুমা দাদু চোরের মতো তুলসীমঞ্চ ঠাকুরদালান ছেড়ে পালিয়ে এল।প্রথম রাত দিসপুর স্টেশনে।তারপর সেখান থেকে কয়েক সপ্তাহ পর যাদবপুর স্টেশন।তারপর মানা বেস ক্যাম্প।তারপর জগদলপুর।আর আমি?কী বলব তোকে টবি।ঘুরছি ঘুরছি ঘুরছি।গড়ফা ফার্স্ট লেন,প্রতাপগড়,মনসাতলা,কালিকাপুর,কসবা।আজও একটা বাড়ি হলো না আমার।আর মণ্ডলবাবু বলেন কী না আমিই সব সর্বনাশ করলাম দেশের!আইআইটি প্রিলিম্স পাশ করেও বসতে পারলাম না ভাইভায়।সংরক্ষণ টবি।তোদের ওসব আছে?ল্যাব কোটা।অ্যালসিশিয়ান কোটা।লেড়ি কোটা।আর তারপর একদিন দেখলাম অযোধ্যা পাহাড়ে।একটাই জামা হাত ঘুরিয়ে পরে বাড়ির পাঁচজন।সেই আদিবাসী হতদরিদ্রকেও উৎখাত করে রিসর্ট বানাচ্ছে সংরক্ষণের আই এ এস বাবুমশাই।ওসব বুঝবি না তুই।হয়তো বলবি ওই কবিতা গল্প নিয়ে থাক।

           সে যাই হোক।টিটাগড়ই হবে বোধহয়।সারাদিন কলম পেশার পর রাতের বেলা রাণাদার বাড়ি যাচ্ছি।'এখানে চুড়িদারের পিস পাওয়া যায়'।আমি জানি রাণাদা ইচ্ছে করে ওটা হঠায় না।মনে মনে প্রচুর কৌতুক তাঁর।তবে তাঁর ঘরে লাল পিঁপড়ে গুলোর হুলে মারাত্মক বিষ।কী বললে জানিস সেদিন রাণাদা?বলল,"একজন কবিকে সাধক হতে হয়,তান্ত্রিক হতে হয়,সর্বজ্ঞানী হতে হঢ়।জ্যোৎস্নারাতে নিজের বিবেককে জ্যোৎস্নার আলোয় ধুয়ে নিতে হয়।উন্মাদ হতে হয়।"রাণাদার বইটার নাম কী জানিস?"পাগলদের বাড়ি"।টবি।সত্যিই বলছি।ডবল ডিমের এগ রোলে কামড় মারতে মারতে মনে হচ্ছিল খাটের এক কোণে শুয়ে পড়ি।বাড়ি ফিরব না।রাণাদার অটিস্টিক ভাইপো হাততালি দিয়ে গাইছে "দে দে পাল তুলে দে আর হেলা করিস না"।একদিন জানিস টবি।লেখালিখির জগতেও কোটা হবে।ওবিসি এসসি এসটি জেনেরাল।পত্রিকার সূচী বেঁধে দেবে রাষ্ট্র।আর আমি তখন বলব,"ও রাণাদা।আমি সাধক হবো গো।কারণ অন্য পথগুলোতে সীটগুলো সব ভর্তি গো।"ক্রাচ নিয়ে দৌড়োবে ছেলেটা।সে এক মরণদৌড়।কিতকিত খেলবে.......

 

 

৩।

এসব কথা তোকে বলা যায়।লেখা যায় কোথাও বল?এই আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ল ঝিরিঝিরি।সকলের মুখে হাসি।পিকনিক হবে।শীত পড়ে গেছে।ওষুধদোকানির মুখে হাসি।আবার বাড়বে সর্দিকাশি।আহা।বিক্রি বাড়বে।গেল মাসটা ডাউন গেছে।ওই যে বিয়ে করল গেল মাসে লিফট ম্যান ছেলেটা।ও আর বৌয়ের মুখে হাসি।বেশ নকপুলের রাস্তাঘাট সুইজারল্যান্ড বনে যাবে।যাঁরা তোকে গোর দিয়েছেন তাঁরাও কি হাসছেন না?বৃষ্টি পড়লে তোদের বডিগুলো ডিকমপোজ হবে তাড়াতাড়ি। তোরা মাটিতে মিশে যাবি টবি।আর দেখা হবে না।কাকে বলব এসব কথা?তুই শুনতিস।আর কেউ শুনবে?ষড়যন্ত্র করবে।উৎখাত করে দেবে।আসাম থেকে বাংলা।বাংলা থেকে ছত্তিশগড়।ছত্তিশগড় থেকে মরিচঝাঁপি।রায়মঙ্গলের ওইপাড়ে জমা হবে পুলিশ বোট।হাতে ওগুলো কী রে?বন্দুক বুঝিস?লোডেড?পালা।পবিত্র।তুই পারবি।আমি কী করে পারব।ফোন আসে।বেলা আড়াইটা।বাবা মায়ের কান্নাভরা স্বর।"মুনাই রে।টবি নেই।"তুই নেই?কোথায় নেই?দিব্বি আছিস।একবার বৃষ্টি হলেই কেউ ডিকমপোজ হয়ে যায় নাকি?এতো সহজে?তোর হাড় ডিকমপোজ হতে পারে।মাংসপেশিও।কিন্তু তোর ওই মায়ালু চোখদুটো!ওরা কীভাবে ডিকমপোজ হবে বল দেখি?ওরা যে সব দেখেছে।ওরা দেখতে পাচ্ছে সব।

-আর একটু কাটি?

-না থাক।

-এই দেখুন।ব্লাডার।এম্পটি।

-বেশ।আর পাকস্থলি?

-একটু ভাত আছে।সামান্যই। 

-ওটা জারে রাখো।ভিসেরা পাঠাতে হবে।

-আর বুকটা?দেখুন।রক্ত জমে আছে।হার্ট অ্যাটাক।

-বাহ।বেশ বললে তো?কী নাম তোমার?

-আজ্ঞে রাণা।রাণা সামন্ত।

ছ্যাতলা পড়া দাঁতে রাণাদা হাসছে।হাসপাতাল মর্গের গেটে।সইসাবুদ সেরে কী মনে হল,জানিস টবি।তোর পাশে একটু ঘুমোতে দিবি আমায়?শান্তিতে?অনেক তো দৌড়োলাম।বাড়ি নেই ঘর নেই।খালি স্কোয়ার ফিট।আর স্কোয়ার ফিট।এবার বিশ্রাম নেব।তোর পাশে।কবর খুঁড়ে দেবে রাণাদা।রাণাদা কথা দিয়েছে।আমার শরীরে পচন ধরবে না।কথা দিচ্ছি আমিও।যতোদিন তুই থাকবি।আমিও থাকব।তোর বন্ধুরা অনেক আন্তরিক।ছলনা করে না।এখন শুধু রাণাদা যদি দয়া করে একটু।"ও রাণাদা।দেখো না একটু।আমি আমার নিজের কবরটা খুঁজছি যে।"

 


No comments:

Post a Comment