বাক্‌ ১৫০ ।। বাক্-স্বাধীনতা : ব্যক্তিগত দর্শন -- দশম পর্ব ।। শুভদীপ নায়ক

 

জীবনের ধারণা বলতে মানুষ যা মনে করে তা হল প্রকৃত অর্থে 'বেঁচে থাকা' । বেঁচে থাকা বলতে ব্যক্তিবিশেষ তাঁর জীবদ্দশাকেই চিহ্নিত করে । যেহেতু একজন ফিলোজফারের কাজই হল নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া, সুতরাং দর্শনে 'জীবনের ধারণা' ব্যাপারটার ব্যাপ্তি বিরাট, এমনকি মৃত্যু পেরিয়েও অনন্তজীবনযাত্রার মধ্যে সেই ধারণা নিহিত । আজও আমরা বাস্তবিক ধারণা, বেঁচে থাকা, মতাদর্শের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছি গ্রিক ফিলোজফির সত্য । ফিলোজফির ডিসকোর্স, সাহিত্যের মূল্যায়ণ, আদর্শ, নৈতিক চেতনা কখনওই ব্যক্তির মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায় না । ব্যক্তি থেকে দর্শনের জন্ম হয় ঠিকই, কিন্তু ব্যক্তির মৃত্যুর পর সেই আদর্শ, সেই সাহিত্য-মূল্যায়ণ ছড়িয়ে পড়ে জাতির মধ্যে । একটা জাতি তাঁর আত্মপরিচয় খুঁজে চলে সেই মতাদর্শের মধ্যে, কখনও-বা সেই মতাদর্শকে প্রশ্ন করে, ছিন্ন করে, জিজ্ঞাসা জন্মায় সেই ব্যক্তির জীবন ও কাজ নিয়ে, তৈরি হয় সংশয়, জাতির অগ্রগতি স্থগিত হয়ে পড়ে, সমস্তটাই সম্ভব হয়, কিন্তু ব্যক্তিটির সেই 'জীবনের ধারণা', যা তিনি জাতির মধ্যে প্রেরণ করে দিয়ে গেছেন, তা কখনওই মুছে যায় না । মৃত্যু পারে না ব্যক্তির জীবনের সমস্ত কিছুকে নস্যাৎ করতে, নিশ্চিহ্ন করতে । ঠিক তেমনই, একটা সম্পূর্ণ জাতি কখনওই মুছে ফেলতে পারে না ব্যক্তির অস্তিত্বকে, অন্তত যে অস্তিত্ব জাতির ইতিহাসকে নিরন্তর প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে সময়ের মধ্যে দিয়ে।

আজ আমরা সংস্কৃতির মধ্যে যেসব প্রচলিত মজ্জাহীন, স্থূল মেরুদণ্ডের লেখককে দেখি তাদের অধিকাংশই হারিয়েছে মৌলিক সাধনার পথ । তাদের মধ্যে নেই নতুন অভিজ্ঞতার ভ্রমণ । বৃত্তাকার পথের ভাবনায় তৈরি হচ্ছে তাদের লেখালিখি । তাৎক্ষণিক ঘটনার মধ্যে সহজেই ভেসে যাচ্ছে তাদের চিন্তাশক্তি । অথচ মানুষের যা চিরাচরিত সমস্যা, সমস্যা মনুষ্যত্বকে সময়ের মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে শিল্পে,সাহিত্যে, ভাস্কর্যে, দর্শনে রক্ষা করা, তা কোনভাবেই কবি বা লেখকের কর্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছে না । কবি বা সাহিত্যিক আজ সাধারণ মানুষের কেউ নয়, সে হয়ে উঠেছে বিখ্যাত একটা সামাজিক ব্র্যাণ্ড, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখছেন বড় বড় প্রকাশনা সংস্থার ব্যবসাকে । সেই ব্যবসার একটা বিরাট বড় অ্যাসেট তিনি, কখনও কখনও ব্যবসা তার নিজস্ব অ্যাসেটকে রক্ষা করে পুরস্কার দিয়ে, সম্মান দিয়ে । অন্যান্য পুরস্কার, ন্যায্য পুরস্কার বা স্বীকৃতির সঙ্গে এই নাটকীয় পুরস্কারের কোনও মিল নেই । যেহেতু অর্থনীতিতে বই একটা কমোডিটি (রাজনৈতিক চক্রান্ত ও সরকারের দুরভিসন্ধির তাগিদে বইকে কখনও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য করা হয়নি বা হবেও না, কেবল পণ্য করেই রেখে দেওয়া হবে ), তাই বড় প্রকাশনা ব্যবসাগুলো কখনোই চাইবে না কবি বা সাহিত্যিকরা মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হোক, গণ আন্দোলনে ভূমিকা নিক । যিনি প্রকৃত লেখক, তিনি তাঁর জীবনকে উৎসর্গকে করেন বৃহত্তর প্রগতির উদ্দেশ্যে । সমাজের মধ্যে জীবনের গতি আর সংঘর্ষ অবিরাম লেগেই আছে । আর সেটাই একজন লেখকের, একজন ফিলোজফারের প্রকৃত টেক্সট, যদি তাঁর লেখকজন্ম সময় আর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে । অস্পষ্ট চেতনা, জীবনের অন্তরাল, মনোজাগতিক প্রতিসরণ, প্রেমের মরীচিকা, পার্থিব জীবন, দ্বিধার সিদ্ধান্ত, এইসব অর্থহীনতা থেকে যে অর্থের জন্ম হয়, তাই-ই একজন কবিকে ঠেলে দেয় সঙ্কোচহীন লড়াইয়ের দিকে । দণ্ডাজ্ঞা নিয়েই তাঁর জন্ম, দণ্ডাজ্ঞা নিয়েই তাঁর মৃত্যু ।

একজন প্রকৃত লেখক, ফিলোজফার, সে যখন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বড় হয়, তখন প্রতিটি পদক্ষেপে সে অনুভব করে মানুষের সৎ পাওনাগুলো আসলে লোভীদের লালসাপূর্ণ হাতে বন্দি । সমাজে গরিব, ন্যায়পরায়ণ মানুষেরা আক্রান্ত হয় লোভীদের হাতে,--- এই ঘটনা দেখতে দেখতে সে বড় হয় । ফলে তার মধ্যে জন্ম নেয় সেই স্পৃহা, যা সভ্যতায় মুক্তির দাবি তোলে । মানবজাতি একটি স্কিৎসোফ্রোনিক যন্ত্রণার মধ্যে যেন দীর্ঘকাল আবদ্ধ । সেই যন্ত্রণার ভাষাকে মানুষ ব্যবহার করে, কিন্তু তাকে প্রশ্ন করে না । সেই যন্ত্রণাকে তারা বহন করে, কিন্তু তা থেকে নিরাময়ের কোনও পথ খোঁজে না । পরিস্থিতির বদল তখনই ঘটবে যদি সভ্যতার বদল করা যায়, আরও গভীরে এর অর্থ হল, সভ্যতার ধারণা আমাদের কাছে কী এবং কতটুকু, যদি তার যথার্থ বিশ্লেষণ করা যায়।

সাহিত্যের কাজ হল জীবনের অদেখা দিকগুলো নিয়ে অনন্তকালব্যাপী সৃষ্টি করে চলা । সেই ভূমিকা স্তরে স্তরে আলাদা । সময় ভেদে তার মূল্যায়ণেরও পরিবর্তন হয়েছে । আমাদের বাংলা সাহিত্যে কবি বা সাহিত্যিকের ভূমিকা অতীতে ছিল অনেক গভীর । সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে সাহিত্যিকের যথার্থ গুরুত্বগুলো পরিলক্ষিত হত । কিন্তু বর্তমান সময়ে সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো তেমনভাবে আর সাহিত্য বা সাহিত্যিক নির্ভর নয় । একটা সময়ের পর থেকেই সাহিত্যিকের মতামত আর জাতির নিজস্ব মতামতের মধ্যে তফাতের সূচনা হয়েছে । এই তফাতের দরুণ সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত মতামত রাষ্ট্রীয় রোষানলের সম্মুখীন হয়ে চলেছে । যে ভাষায় তিনি সাহিত্য রচনা করেন, তার পাশে থাকেন না সেই ভাষার সাহিত্যপ্রেমী পাঠকেরাও।

লেখক প্রায় নিজের জীবনের সমস্তকিছুকে নস্যাৎ করে, সব সম্পর্ককে জীবনের মধ্যে থেকে হারিয়েই লিখতে আসে । লেখার জগৎ থেকে সে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে, কিছু সম্পর্ক লেখার জগৎ থেকেও তৈরি হয়, কিন্তু সেইসব সম্পর্ককে অতিক্রম করে যাওয়াই তার ধর্ম । লেখক যদি সম্পর্কের ভিতরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, নিজস্ব প্রতিষ্ঠায় পড়ে থেকে পচতে শুরু করে, তা হলে ভাবনার পথে উঠে যায় গগনচুম্বী বাঁধ । ফলে সে যা রচনা করে, তা ঐ সম্পর্কেরই পরিভাষা, ঐ প্রতিষ্ঠারই নির্দেশ । অথচ এই সমাজতন্ত্রের বুকে কলম হাতে অারও কিছু লেখকের জন্ম হয়, যারা সামন্ততান্ত্রিক প্রথাকে অস্বীকার করতে চায় । তারা কোনও কিছুর বিনিময়ে, কোনও প্রাপ্য বা অর্জনের লক্ষ্যে লিখতে আসে না । রাস্তাই তাদের কাছে চিরজীবন সত্য হয়ে থাকে । সভ্যতার অধিকাংশ পাঠক তাদের লেখাকে প্রশ্ন করে, অস্বীকার করে, আবার সেই লেখাকে ঘিরেই তৈরি করে আলোচনার পরিবেশ, ঠিক যেভাবে মানুষের রক্ত তার নিজের অন্ধকারকে উপহাস করে । ব্যক্তিজীবনে মানুষ জন্মাবার পর থেকেই যে অভিজ্ঞতা লাভ করে, তা হল ক্ষমতার ভাষা, সে যা দ্যাখে তা হল দিকে দিকে ক্ষমতার চোখরাঙানি । তার জীবনের সিদ্ধান্ত ক্রমশ দু-টুকরো হয়ে পড়ে । হয় সে নিজেই ক্ষমতাবান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে ক্ষমতার নিপীড়ন জারি রাখে, অথবা ক্ষমতার আনুগত্য স্বীকার করে নিজের স্বার্থগুলোকে গুছিয়ে নেয়, এবং স্বীকৃতির চূড়া দখল করতে থাকে।

জীবনের মধ্যেই নিরন্তর কাজ করে চলেছে এই বিমূর্ত চেতনা । কখনও জীবনকে ভালোবাসার জন্য তাকে নতুন করে লেখায় জন্ম দেওয়া, কখনও সেই জীবনকেই ভালোবাসতে গিয়ে তাকে লেখার মধ্যে নির্দয়ভাবে হত্যা করা । এই অপচয়, অঘটন, এরই মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে একটা ব্যক্তির আবির্ভাব, একটা জাতির সত্য, একটা ভাষার বহতা স্রোত । লেখকের পক্ষে এই স্রোতই হল মহাকালের মধ্যে প্রকৃত অর্থে বেঁচে থাকা, তাঁর লেখা, তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞা ।

(ক্রমশ চলবে)


No comments:

Post a Comment