(এক)
দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি
২০১৬
থেকে ২০২০ তাঁর জীবনের এই শেষ পাঁচ বছরে প্রতি বছর একটি করে কবিতার বই প্রকাশ
পেয়েছে অলোকরঞ্জনের। ইতিমধ্যে ২০১৩ সালে কবি আশি বছর পেরিয়েছেন। চলে গেছেন
জীবনসঙ্গিনী শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত (২০০৫)। বিধ্বংসী শোক পেরিয়ে কবি উপনীত
হলেন উত্তরপর্বে। তাঁর অন্ত্য পর্বের সৃজনশীলতা শেষ দশকের
রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ায়।
'দোলায়
আছে ছ'পণ কড়ি'। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের
উত্তরপর্বের কবিতায় এক উজ্জ্বল মাইলফলক। সদ্যপ্রয়াত কবির ছ'দশক
জোড়া দীর্ঘ কবিতাযাত্রার শিখরে 'দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি'(২০১৬),
'তোমরা কি চাও, শিউলি না টিউলিপ' (২০১৭), 'শুকতারার আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮), 'ঝাউ-শিরীষের শীর্ষসম্মেলনে (২০১৯), 'বাস্তুহারার পাহাড়তলি' (২০২০) নিয়ে শেষ পঞ্চকের
সূচনা এই হার্দ্যমধুর কবিতার বইটি দিয়েই। পাঠক লক্ষ করবেন তাঁর অধিকাংশ কবিতার বইয়ের নামও
ছন্দোময়, তাঁর কবিতার মতোই। মালার্মের মতো তিনি বিশ্বাস করেন,
সরকার আসবে যাবে, কিন্তু ছন্দ থেকে যাবে।
বক্ষ্যমাণ বইটির নামে এসে গেছে একেবারে লোকায়ত, প্রায় সবার জানা এক ছেলেভুলানো ছড়ার চরণ এবং ছন্দ,
শ্বাসাঘাতপ্রধান স্বরবৃত্তে। বইয়ের নামকরণে এবং অনেক কবিতায়
বেলাশেষের বা বিদায়ের ছবি, কিন্তু সে বিদায়সুর কোনো নিরাশায়
তলিয়ে যায় না। এইখানে
তাঁর জীবনদেবতা রবীন্দ্রনাথের সুরে সুরে গেয়ে উঠতেই পারেন সুধাকণ্ঠ অলোকরঞ্জন 'মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ… '। 'অঙ্গবিহীন
আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ' ভরিয়ে তোলবার পিপাসায়, হলই বা সেটা সায়ন্তনের 'ক্লান্ত' ফুলের গন্ধ।
মূলত 'যৌবনবাউল' এবং অংশত তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের
কবিতা নিয়েই তাঁর কবিতার অনেক আলোচনা শেষ হয়, 'মরমী করাত'
(১৯৯০) বা 'রক্তমেঘের স্কন্দপুরাণ'(১৯৯৩) অবধি যার শেষ সীমা। এর একটা কারণ হয়তো, ছোট
ছোট প্রকাশন থেকে বের হওয়া তাঁর অনেক বইয়ের অলভ্যতা, দে'জ-কৃত কবিতা সংগ্রহের এ তাবৎ তিনটি খণ্ডই প্রকাশিত। 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' নিঃশেষিত।
এইসব কারণে এরপর থেকেই বুঝি শুরু হয়ে যায়
পূর্বজ আর এক দাশগুপ্ত কবির মতো পাঠক হারানোর বৃত্তান্ত। উত্তরপর্বের জীবনানন্দ
বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর অনাগ্রহ কি একই ধাঁচের নয়?
এক নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। ছোটোবেলায়
ঠাকুর্দার মুখে শোনা গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের এই বীক্ষা মেনে কবিতা থেকে কবিতার সঞ্চারপথে পুনরুক্তিপ্রবণতা
খারিজ করে চলা অলোকরঞ্জনের নানা পর্যায়ের কবিতার ধরতাই এখনও অনেক কবিতাপ্রেমী
পাঠকের অধরা। কবি তাঁর ‘সযত্নে সুরচিত লিরিক কবিস্বভাব,
তাঁর লিরিক-একাগ্রতার বিশুদ্ধ তীব্রতা’ কিছুটা
কমিয়ে লিখতে শুরু করেন, তাঁর নিজের কথায় 'কিছু argumantative ও dialectical কবিতা', যা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক ও বিশ্বজনীন। পূর্বধার্য
কাব্যমীমাংসার পরিবর্তে উঠে আসে কাব্যজিজ্ঞাসা।
এ শতকে তাঁর লেখালেখি নিয়ে আলোচনা নজরে পড়ে কম। শুধুমাত্র শেষ পাঁচটি কবিতার বইয়ের
ঋদ্ধিঋণ বাংলাভাষাভাষী হিসেবে বর্তমান বিনীত প্রতিবেদককে কৃতজ্ঞ করে।
ইতিমধ্যে
দ্বিতীয় যন্ত্রবিপ্লব সাধিত হয়েছে। মোবাইল, কম্প্যুটার,
ইন্টারনেট, আই ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া -শাসিত বিশ্বে কবি অনুসন্ধান করতে
লাগলেন প্রাথমিক মানবিক সম্পর্কগুলোকে। পারস্যের কবি হাফিজের অনুরণনে লেখা জার্মান
মহাকবি গ্যোয়েটের 'ডিভান' কাব্যের
বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে বাউল-সুফি-মরমিয়া-দরবেশদের ভাবলোককে পুনরাবিষ্কার করলেন ‘যৌবনবাউল’। মোবাইলে মুখ-গোঁজা ভাষাহীনতার যান্ত্রিক
পৃথিবীতে আমরা দেখব ‘যৌবনবাউল’ ক্রমশ
তাঁর অনাহত প্রতীতির বিদীর্ণ জায়গাটার শুশ্রূষায় নিবিষ্ট। ভোগবাদের মহামারীর
বিপরীতে বহিরঙ্গ ছেড়ে চিদঘন অন্তর্লোকের অনুসন্ধানী অলোকরঞ্জন। ‘দোলায় আছে ছ’পণ কড়ি' (২০১৬)
তাঁর এই পর্বের উল্লেখ্য ফসল, শুদ্ধতার কাব্যগুণে ঋদ্ধ।
'দোলায়
আছে ছ'পণ কড়ি' বইয়ের বিভাব কবিতায় কবি
লিখছেন,
মনের ভেতর গুমরে ওঠে
ধাই-মার সেই দাবি
'মাছের কাঁটা পায়ে বিঁধলে
দোলায় চেপে যাবি
দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি
গুনতে গুনতে যাবি'...
এ বইয়ের 'পিতৃবন' কবিতায় তাই পেয়ে
যাই তাঁর স্নেহাপ্লুত বাবা বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্তকে, শ্রীমান
অলোকরঞ্জনকেই যেন তিনি চেয়ে চেয়ে দেখছেন তাঁর 'ক্ষমাহীন দুর্বলতায়'। দূরান্বয়ে স্মরণে আসে, কবি শ্রীমধুসূদনের 'মেঘনাদবধকাব্যে'র 'প্রেতপুরী'
নামধেয় অষ্টম সর্গে লক্ষ্মণের শক্তিশেলের প্রতিকারকামনায় সশরীরে
স্বর্গলোকগামী রামের দর্শন পেয়ে ঊর্ধ্বলোকবাসী পুত্রশোকে লোকান্তরিত দশরথের
স্নেহাকুল মুখচ্ছবি,যিনি রামকে দেখে বলে উঠছেন, 'আইলি কি রে এ দুর্গম দেশে / এতদিনে, প্রাণাধিক,
দেবের প্রসাদে,/ জুড়াতে এ চক্ষুর্দ্বয়?'। 'পিতৃবন' কবিতায়
অলোকরঞ্জন দেখেন, তাঁর পিতার পিছনেই দাঁড়িয়ে পিতামহ
দক্ষিণারঞ্জন, 'যৌবনবাউল'-এর সুখ্যাত 'আমার ঠাকুমা' কবিতার সেই 'শহরবিদ্বেষী'
মানুষটি, যিনি সাঁওতাল পরগনার রিখিয়ায় ভিটেপত্তন করে তাঁর বড়ো নাতি অলোকরঞ্জনের বয়স যখন 'বড়োজোর পনেরো', তখনই সেই জ্যেষ্ঠ পৌত্রের হাতে 'তবু আমায় পারিবারিক দুর্গাপূজার ভার তুলে দিয়েছিলেন'।
এভাবেই পরিজনেরা ঘুরে ঘুরে আসেন অলোকরঞ্জনের কবিতায়, যেমন
অনুধাবন করেছেন শঙ্খ
ঘোষ ('আমার বন্ধু অলোকরঞ্জন')। আর সেই
পরিজনদের সীমা বিস্তারিত হতে হতে চলে দুনিয়াভর, রক্তসম্পর্কহীন দীনতম বৃদ্ধ মানুষটিও কবির আত্মীয়।
আর, এ
বইতেই টানা গদ্যে লেখা 'অনাবাসী যদি অনুবাদ করে' কবিতায় লিখলেন, 'তুলসীতলার আজলকাজল মায়ামদির নিরাপত্তার ঘেরাটোপ থেকে একবার বেরিয়ে পড়লে
ইহমানুষের কপাল থেকে বাস্তুদেবতার আশীর্বাদ চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে যায়, তার বরাতে তখন চলতে থাকার চালচিত্তির ছাড়া অন্যতর কোনো বিধিলিপি অবশিষ্ট
থাকে না। তখন থেকেই সম্ভবত ভাষাই হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র আবাসন।' হাইডেগার-অনুরণিত এই আভাষণ অলোকরঞ্জনেরই সিলমোহর হয়ে ওঠে আজকের ভুবনজোড়া শরণার্থীর মেলায়।
অলোকরঞ্জনের কবিতা-বইয়ে শতেক যুগের কবিদলের অবিরল আনাগোনা, শতেক যুগের গীতিকা হাতে। এ বইয়ের 'স্বরশয্যায়' কবিতায় স্বভাবসম্মিত সৌজন্যেই উপস্থিত
শিল্পাচার্য শিলার ও শিষ্য নোভালিস।
অলৌকিক
শৈলীতে অমোঘ আশ্বাস আসে বইটির সবশেষ কবিতায়:
আমার জন্য হা-হুতাশন কোরো না,
অরুণাভ,
উত্তরাধিকার সূত্রে পুণ্য পারমিতার
ছ'পণ কড়ি সঞ্চয়িত আছে আমার দোলায়,
বাকিটা পথ গুনতে গুনতে যাব!
এ বই
কবি উৎসর্গ করেছেন কবি নাসের হোসেন আর বর্তমান প্রতিবেদককে। এ তাঁর উদার
কবিচারিত্র্যেরই এক মুদ্রা।
(দুই)
তোমরা কী
চাও, শিউলি
না টিউলিপ?
'তোমরা কী চাও, শিউলি না
টিউলিপ?' (২০১৭) এর পরবর্তী বই। উৎসর্গ করা হয়েছে অমিয় দেব এবং সৌরীন ভট্টাচার্যকে। কবির প্রথম পর্বের কবিতা ছিল দেশজ নিসর্গ,
সাঁওতালি গান আর দাদারিয়া নাচে ভরা লোকজীবন আর আস্তিক্যবোধকে জড়িয়ে।
তাকে তিনি শিউলি বলে অভিহিত করছেন। আর উত্তরপর্বের আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া-লাগা
কবিতা তাঁর টিউলিপ ফুল। পাঠকের কাছে প্রশ্নময় শিরোনাম তাই, 'তোমরা
কী চাও, শিউলি না টিউলিপ?' আমরা অবশ্য
দুটোই চাই। শঙ্খ ঘোষের আহ্বানে অলোকরঞ্জনের কবিতার এক অনুবাদ-সংকলন প্রকাশ
উপলক্ষ্যে তাঁর কবিতা নিয়ে দু-কথা বলতে গিয়ে এমন কথাই জানিয়েছিল এই প্রতিবেদক।
কবির
ঠাকুর্দা দিনাজপুরের প্রধান
শিক্ষক দক্ষিণারঞ্জন দাশগুপ্ত অবসর গ্রহণের পর সাঁওতাল পরগনার রিখিয়া গ্রামে নতুন
করে ভিটে পত্তন করে বাস করতে শুরু করেন। বড়ো নাতি অলোকের জন্মের পর তিনি সেখানে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন, অলোকরঞ্জনের ওপর এই পুজোর ভারও দিয়ে যান তিনি । পুজো উপলক্ষ্যে বৃহৎ যৌথ
পরিবারের সবাই সেখানে জড়ো হত। অলোকরঞ্জনের শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি রিখিয়ার সঙ্গে
যুক্ত, ‘যৌবনবাউল’-এর বহু কবিতায়
রিখিয়া, বাবুডি, আমরুয়া, চানন নদী, হিরনা টিলা, ত্রিকূট পাহাড়সহ এখানকার নিসর্গ ও
লোকজীবনের ছবি। প্রায় চল্লিশ বছর চলেছিল এই বসতবাড়ির পুজো। বইটির বিভাব কবিতাতেই
আমরা তাই দেখব, 'বসত
বাড়ির শেষ বারকার পুজোয়/ শেফালিকার শুভ্র আগুনটাকে/ চয়ন করে বেরিয়ে পড়লাম/ প্রতিমা
নিরঞ্জনের আগে'। এই বেরিয়ে পড়া থামল এক ভিনদেশের গাঁয়ে,
'সেখানে দেখি অজস্র টিউলিপ/ যা শুধু লাগে নশ্বরের কাজে'। শিউলি পূজার উপচার, অন্যদিকে টিউলিপের তেমন কোনো
আধ্যাত্মিক গরিমা নেই, নশ্বরের কাজেই তার ব্যবহার। মরমী কবির
প্রথম পর্বের কবিতা যদি অতীন্দ্রিয়তায় লগ্ন, পরবর্তীতে তাঁর
কবিতায় নৈমিত্তিকের নশ্বর সৌন্দর্য ও কদর্যতার অভিক্ষেপ।
উত্তরপর্বে
তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া লাগলেও দেশজ আচার, পার্বণ নতুন তাৎপর্য পায় তাঁর কবিতায়।
'ভাইফোঁটার
দেয়ালটা' কবিতায় বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে প্রয়াত মেজদির জন্য
প্রবাসী ভাইদের বেদনা এক চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে ওঠে কবির অননুকরণীয় শৈলীতে : 'মেজদি মারা গেলে আমরা ছ-ভাই যথারীতি প্রথানুগত সম্ভ্রমে টালিগঞ্জের/ পোড়ো
সেই বাড়িটায় জড়ো হয়েছিলাম। বাপুয়া এসেছিল ব্রেজিল থেকে/ বিবদমান দুই শিবিরের
মধ্যে সাময়িক মোকাবিলা/ স্থগিত রেখে ৷ লিবিয়ায় ভ্রাতযুদ্ধে শামিল হয়ে
ডানচক্ষু/ জখম হওয়া সত্ত্বেও স্বয়ং পিন্টু এসে হাজির, তাকে
আগলিয়ে/ ধরে ধরে এনেছিল বাদল আর বুলবুল ৷ গোরা আজকাল কানে/ শুনতেই পায় না,
তবু একে-ওকে জিগ্গেস করে শেষ মুহূর্তে কী করে জানি হাজিরা দিল।/
পাশের বাড়ির মালি তালা খুলে আমাদের নিয়ে গেল চোরাগোপ্তা/ একটি কুঠুরিতে যার
একটাই মাত্র দেয়াল । যে সব ভাই ভাইফোঁটার দিন/ আসতে পারেনি সেই দেয়াল জুড়ে
তাদের জন্য মেজদির দেওয়া চন্দনের ফোঁটা থরে থরে বিকীর্ণ রয়েছে!/প্রথমে অনপনেয় যুদ্ধাপরাধীর
মতো নিজেকে মনে হলেও পরক্ষণে মনে হল/এ আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রপ্রদর্শনী'।
লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বরাবরই আশাবাদী
অলোকরঞ্জন। শেষ দিকে মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই লিখেছেন। 'অমৃতলোক'
পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক সমীরণ মজুমদারকে নিয়ে একটি কবিতা আছে এ
বইতে। শেষ দু-লাইন,
'পরবর্তী বিশেষ সংখ্যার জন্য অভিমন্যুতার অভিমানে
সে যেন আমৃত্যু লেখে লিটল ম্যাগাজিনের টানে।'
('সমীরণ মজুমদার')
অভিমন্যুর
পুরাণপ্রতিমা শেষ দশকে তাঁর খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, জয়-পরাজয় বলে কিছু হয় না, নিজের সত্যের কাছে সত্যবান থাকাটাই জয়। অভিমন্যুর মতো তিনি নিজেকে দ্বিতীয়
বিজয়ী বলে দেখতে চান। শেষ দিকে তাঁর ভয়, কলকাতায় এলে আমি
বাংলা ভুলে যাব।…আমি যদি কলকাতা থেকে দূরে কোথাও প্রয়াত হই,
আমার স্মৃতির কলকাতা বুকে নিয়ে সানন্দে মরে যাব।' ('সন্ধিক্ষণের সাক্ষাৎকার', নাচের আড়ালে লুকিয়ে কে
ছায়ানট?, ২০১৬)
এ
বইয়ের শেষ কবিতা ' না-দেখা সে-ও আরেক দেখা' সদ্যপ্রয়াত কবিবন্ধু আলোক সরকারের স্মৃতিতে অনুস্যূত :
আসন্ন বই মেলার মুখে
শরৎমেঘের সিংহদুয়ার
তীর্ণ হয়ে চলে গেলেন আলোক সরকার;…
ভাবানুষঙ্গে
পাঠকের মনে পড়বে কবির 'ধুলোমাখা
ইথারের জামা' (১৯৯৯) বইয়ের 'আলোক সরকার'
কবিতা, যেখানে দুই কবিবন্ধুর হৃদ্যতাই শুধু নয়,
লিখনভঙ্গিমার সূক্ষ্ম ফারাকটিও লক্ষণীয়। সেই বইয়ের নামকরণেও তাঁর
কাব্যপ্রস্থানের দ্যোতনা : কবি তাঁর ইথারের জামাটাই পরে থাকেন, শুধু তার গায়ে
মেখে নেন ব্রহ্মাণ্ডের ধূলি।
(তিন)
শুকতারার
আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি
'শুকতারার
আলোয় পড়ি বিপর্যয়ের চিঠি' (২০১৮) তাঁর পরবর্তী বই। 'গিলোটিনে আলপনা' বা 'মরমী
করাতে'র মতো এ বইয়ের নামকরণেও উদ্যত বিরোধাভাস । আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যই যার মূলসূত্র। এই
বিপর্যাসের টানে আশাবাদও ধূসরিম হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায় :
কারুক্কে বলিনি তা :
আমার ভিতরে
এক ধরনের ধূসরিম
আশাবাদ
তৈরি হতে চলেছে
তাঁর শিকড়চেতনা সংলগ্ন হয় বিশ্বজোড়া
শরণার্থীচেতনার সঙ্গে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী-সংকটে তিনি স্মরণ করেন আরাকান
রাজসভায় মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের কথা ('রোহিঙ্গা!
রোহিঙ্গা!')
তবু বিশ্বসংকট ও বিপর্যয়েও তিনি শুদ্ধ কবিতার শুকতারার আলোকে
ভুলতে পারেন না। প্রাচীন গ্রিসের মাউন্ট হেলিকনের আবহমান ধারায় অভিস্নাত হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেসের
অনুগামী কবি :
কোথায় কবে শুনেছিলাম মাউন্ট হেলিকন
রয়েছে গ্রিসে, তারি
হৃদয় থেকে
ঝরনা হয়ে কবিতা নামে যার শ্রুতিলিখন
করে গেছেন হোমার, স্যাফো, সোফোক্লেস;
আরও আমার অনেক শতেক পূর্বসূরি
(আবহমান)
গ্রিসের
মিথসঞ্জাত হেলিকন ঝরনাধারা অনায়াসেই মিশে যায় কবির নিজস্ব রাবীন্দ্রিক মুক্তধারার
মুক্তিস্রোতে।
(চার)
ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে
ঝাউ-শিরীষের
শীর্ষ সম্মেলনে (২০১৯) তাঁর উপান্ত্য বই। অনুজ কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য এবং
পার্থপ্রিয় বসুকে উৎসর্গ করা। 'বিভাব কবিতা' বিষয়টি বাংলা কবিতায় তাঁরই সংযোজন। এ
বইয়ের বিভাব কবিতায় আমরা দেখব, পরিবেশ-সচেতন অলোকরঞ্জনকে,
যিনি ঝাউ-শিরীষের শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে দেখছেন একটিও গাছ নেই! আমরা জানি, ইতিমধ্যেই
তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন পরিবেশবাদী জার্মান কবি সারা কীর্শের কবিতা। আর ‘যৌবনবাউল’-এর দিন থেকেই তাঁর দর্শনে, 'বৃক্ষের বিষাদনেত্রে আয়ত
পত্রের অশ্রু ঝরে।'
আত্মসমালোচনার ঢঙে কবিদের নার্সিসাস-বৃত্তিকেও
দায়বিদ্ধ হতে হয়,
'আর নার্সিসাস আমরা এখনও
পদ্যের চর্চা করি,
তবে কিনা প্রত্যেকেই পড়ি শুধু নিজের কবিতা!'
এ বইয়ের শেষে অনুস্যূত হয়েছে রাজেশ্বরী দত্তের জন্মশতবর্ষ
উপলক্ষ্যে একটি অসামান্য দীর্ঘ কবিতা 'রাজেশ্বরী : একটি শোকগাথা'। কবি উপনীত এমন এক
দুনিয়ায়, যেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউ-টিউব,
স্মার্ট ফোনের তড়িঘড়ি সংযোগময়তার দৌলতে বসুন্ধরা থেকে 'নির্বাসিত নিভৃত পৃথিবী'।
এ কবিতা
শেষ হচ্ছে,
আমার গহন
কুলুঙ্গিতে রাত্রিদিন কয়েকটি মোম জ্বলে / উদযাপনের উল্লাসে নয়,
নিছক বেঁচে থাকার কৌতূহলে।
দ্বিতীয়
পাঠে এই শেষ দু লাইনের প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়তে পারে। দুটি চরণে ১০+১২ বাইশ
মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । উদ্ধৃত প্রথম লাইনে ৩+৩+৪ এবং ৪+৪+২+২ এর সরল, প্রথানুগত বিন্যাস। কিন্তু দ্বিতীয় লাইনে তা
ভেঙে যাচ্ছে ৫+৩+২
আর ৩+২+৩+৪ এর বিপ্লবে।
গত
ষাট-সত্তর বছরে যে-স্বল্পসংখ্যক গুণিজন বাংলাভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে ব্রতী,
অলোকরঞ্জন তাঁদের অন্যতম। নতুন নতুন সমাসবদ্ধ পদ বা প্রতিশব্দ
নির্মাণই শুধু নয়, কবি ব্যবহার করেন মান্য বাংলায়
অধুনা-অপ্রচলিত মধ্যযুগীয় শব্দ অথবা লোকভাষার শব্দ। এ বইতে যেমন এসেছে মাস্তুল
শব্দের প্রতিশব্দ 'মালুমকাঠ' ( 'প্রতিশব্দেরা')। আর 'ভিসা ও ভবিষ্যৎ' কবিতায়
এক অবিস্মরণীয় চিত্রকল্পে দেখি, তাঁর লুপ্ত ভিটের
লাইব্রেরিতে রেখে যাওয়া দ্বিজ মাধবের পুঁথি এক কামিনী ফুলের ঝাড় হয়ে ফুটে আছে।
(পাঁচ)
বাস্তুহারার পাহাড়তলি
বাস্তুহারার
পাহাড়তলি (২০২০) আপাতত তাঁর শেষ বই। ইতিমধ্যে অভূতপূর্ব এক অতিমারির কবলে পৃথিবী কম্পমান। সংবেদনশীল কবির
অনুভূতিকে তা স্পর্শ করে স্বভাবতই। তার ছাপ এ বইয়ে।
গদ্যে
লেখা এ বইয়ের বিভাব কবিতায় দেখব, 'এতদিন ধরে অন্তরঙ্গ যে সমস্ত আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে পথ চলছিলাম একে একে
তাদের নিজস্ব জন্মভিটেয় নামিয়ে দিয়ে ভ্যানুইবের সৈকত ঘেঁষে বাসটা আমায় পৌছিয়ে
দিল অস্তাচলে বাভারিয়া জঙ্গলের মনঃপূত একটি পরিসরে। পাহাড়তলির পর পাহাড়তলি
দিয়ে গাঁথা এই জায়গাটা যেন আমার জন্যেই নির্বাচিত হয়েছিল।'
বিভাব কবিতায় আমরা আরো দেখব, তাঁর যত্ন-আত্তির একবিন্দু বিরাম নেই। ক্ষণে ক্ষণে শরীরের তাপমাত্রা মেপে
দেখা হচ্ছে । দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত এক নার্স বৌদ্ধ হবে বলে কবির কাছে শিখছে
পালি ভাষা। কবি বলছেন, 'না, এখন থেকে
প্রকাশ্য কোনো আলোচনাচক্রে যোগ দিতে আমি যাব না আর। মাত্র ন-দশটি
পুঁথি-পত্তরসুদ্ধু একটিমাত্র নৌকো নোঙরে বেঁধে রেখে দিয়েছি, এইমাত্র। ধরিত্রী আমার ভঙ্গুর ভ্রূযুগ সন্ধিক্ষণে তার বরণডালা ছুইয়ে
দিয়ে এক লহমা তাকাতেই আমার শিরা-উপশিরায় বেজে উঠল আমার সমগ্র বাঁচার সজল
পিছুটান।' এমনতরো প্রসন্ন বিরাম বা বিদায়ের প্রস্তাবনা দিয়েই
সূচিত হয় বইটি।
সংগীতের মতো শিল্পস্থাপত্যকলারও ভিতরমহলের বাসিন্দা কবি। তাঁর কাব্যপ্রবাহে যেমন সংগীতের নানা রাগরাগিণী,
বিভিন্ন রবীন্দ্রগানের অজস্র উল্লেখ, তেমনি
আছে রোমের ধ্রুপদী স্থাপত্য, সিস্টিন চ্যাপেল বা
মিকেলেঞ্জেলোর নানা শিল্পসুকৃতির কথা। রবীন্দ্রনাথ এবং অমিয় চক্রবর্তীর পরে তাঁকে
আমাদের আন্তর্জাতিক কবি হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
২০১৯ এর ১৫ এপ্রিল এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্যারিসের শিল্পসুষমামণ্ডিত
নতরে দাম (Notre Dam) গির্জা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের
উদ্যোগে জোরকদমে চলছে সংস্কারের প্রকল্প। এ বইয়ের প্রথম কবিতা ‘ধ্বংস ও প্রজাপতি'তে দেখছি আমাদের আশাবাদী কবিকে।
তিনি প্যারিসে এসে দেখছেন ঝলসে-যাওয়া নতরে দাম চার্চ। তার সামনে কিশোর চারণ কবির দল গান গাইছে ধ্বংস থেকে
পুনরুজ্জীবনের আশায়। ধ্বস্ত চার্চের মতো প্রবীণ কবির নিজেকেও মনে হচ্ছে এক
ধ্বংসাবশেষ। । তবু
কিশোরদের যৌথ সংগীতের লহরীতে কবি আত্মশক্তিতে ভর দিয়ে দাঁড়ান। আর তক্ষুনি উঠে আসছে
অমোঘ এই মৃত্যুঞ্জয়ী উচ্চারণ, কবিতার শেষ দুই চরণে :
'আমার ডান কনুই ঘেষে মৃত্যুপরোয়ানা
খারিজ করে কাঁপতে থাকে প্রজাপতির ডানা…'
তাঁর প্রিয় জার্মান দার্শনিক মার্টিন
হাইডেগারের কথা এ বইতেও স্বভাবতই উঠে এসেছে, “কবিদের
সর্বাগ্রণী দার্শনিক তুমি, তুমিই তো/ শিখিয়েছ 'মানুষের অস্তিত্বের আবাসন ভাষা' '--। প্রসঙ্গত 'মার্টিন হাইডেগার' শীর্ষক এ কবিতার প্রথম পাঠক এই
প্রতিবেদক, যার কাছে দূরভাষে এ কবিতাটি ভেসে এসেছিল। বস্তুত
হাইডেগারের এই সদুক্তি আমাদের কবির কাছে প্রায় বীজমন্ত্রের মতো। বাংলাভাষায় নতুন
পরিভাষা বা শব্দনির্মাণ, নতুন ধরনের বাক্যগঠন তাঁর
সারাজীবনের ব্রত। 'টেলি-অপারেটর' কবিতায়
অপারেটরের যান্ত্রিক হিন্দিঘেঁষা বাংলা শুনে তিনি লেখেন, 'তাঁকে
বললাম আমি কিন্তু/ নতুন রকম এই বাংলায়/ অনভ্যস্ত'। বিভিন্ন
কবিতায় এসেছে শিলার, কাফকা থেকে দীর্ঘজীবী জার্মান কবি
এনৎসেনবার্গারের কথা। এসেছে মেহগনির টেবিলে যোজনজোড়া প্রাতরাশের মধ্যেও কবির 'মহামারীর থিমটা' নিয়েই লিখে চলার কথাও। এভাবেই
শাশ্বত আর নৈমিত্তিক একাকার হয়ে আসে অলোকরঞ্জনের উত্তরপর্বের কবিতায়।
তাই বুঝি 'ধ্রুব সংশয়',
'বিষণ্ণ কৌতুক' বা 'সুভদ্র
প্রতিশোধ'-এর মতো অক্সিমোরনগুলো এ বইতেও উঠে আসে আমাদের এই
ক্ষুভিত সময়কে ঘিরে উদ্যত বিরোধাভাসের দ্যোতনা নিয়ে।
এ
বইয়ের উপান্ত্য কবিতার নাম তাৎপর্যপূর্ণভাবে 'বয়েসের নিকুচি'। শ্রীমতী ট্রুডবার্টা দাশগুপ্তের প্রয়াণের পর অশীতিপর অলোকরঞ্জন
হির্শবার্গে তাঁর বাড়িতে একাই থাকতেন। বিদ্যাচর্চা, ছাত্রদের
পঠনপাঠন আর গোটা ইয়োরোপ জুড়ে নানা সেমিনারে যোগ দিয়ে। দোতলায় তাঁর লাইব্রেরি। সিঁড়ি ভেঙে এই
লাইব্রেরিতে উঠতে গিয়ে মেরুদণ্ডে চোট পান কবি, ২০১৯ এর
ডিসেম্বরে তাঁর কলকাতায় ফেরা স্থগিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গটি এ কবিতায় এসেছে,
'সিঁড়ি আমায় ভাঙতে পারে এই ভেবে আর সিঁড়ি ভাঙি না--'।
আজীবন পাঠকদের এই ফিডব্যাক বা পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্যে উন্মুখ
থাকতেন প্রবাসী অলোকরঞ্জন। এ কবিতার শেষে তাই দেখতে পাচ্ছি,
'লিখছি
হাজার সংলাপিকা, তোরা যখন বোবা রইলি/… জিইয়ে
রেখে দিয়েছি আমি নিজস্ব এক বাকশৈলী।'
অলোকরঞ্জন লোকান্তরিত। রয়ে গেল তাঁর বাকশৈলী,
সোনার তরী-ভরা তাঁর মহনীয় কাব্যসম্ভার। আমাদের দৃকপাতের প্রতীক্ষায়।
No comments:
Post a Comment