ছত্রি
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও বাইরে বেরোতেই হল। ওষুধটা শেষ
হয়ে গেছে মনেই ছিল না রুমার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোড়টা ঘুরতেই একটা রিকশা ডেকে
নিল। কাছেপিঠে কোনো ওষুধের দোকান নেই। যেতে হবে সেই আমতলা। প্রায় পনেরো মিনিটের
রাস্তা। রাস্তায় বেশ খানিকটা জল জমে গেছে। কোনোমতে রিকশা টানছে প্রায় বৃদ্ধ
লোকটা। মাথায় প্লাস্টিকের প্যাকেট, সারা শরীর ভিজছে। রুমা তড়িঘড়ি বন্ধ ছাতাটা মেলে ধরল। তা
দেখে রিকশাওয়ালা বলে, দিদিমণি,
আমার
লাগবে না। জলেরোদেই তো আমাদের কাজ।
—তুমি এই বয়সেও রিকশা চালাও কেন? ছেলেমেয়ে কেউ নেই?
—আছে। একটা ছেলে। পুনে গিয়েছিল সোনার কাজে
কিন্তু আর ফিরল না। কোনো খবর নেই পাঁচ বছর হয়ে গেল। বউমা, একটা দশ বছরের নাতি। যতদিন পারি ওদের দেখতে
হবে তো! ছেলেটা কখনও ফিরবে কিনা কি জানি!
কথাটা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে রুমা।
কখন যে আমতলা এসে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওষুধ নিয়ে আবার ওই রিকশা ধরেই বাড়ি।
দুপুরবেলা ওষুধ খাইয়ে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
রুমার হাত দুটো ধরে শয্যাশায়ী মা বলে, আমার ছেলে আসবে তো?
—হ্যাঁ মা, অমিত আসবে।
সারাদিনে কতবার যে এই একটা প্রশ্নের
মুখোমুখি হতে হয়!
মা ঘুমোলে ছাদে যায় রুমা। তখনও বৃষ্টির জোর
কমেনি। ছাদে ভিজতে ভিজতে পাঁচ বছর আগের কথা মনে পড়ে। অমিত একটা কাজে গিয়েছিল
মুম্বই।
চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রুমা। চোখের জল
লুকিয়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার আড়ালে। ধুয়ে যাচ্ছে সিঁথির সিঁদুর। যেমনভাবে ধুয়ে
গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে।
স্বার্থপর
আমি রোজ বাজার করি, রান্না করি, ছেলেমেয়েদের খোঁজ রাখি, টাকাপয়সার হিসেব রাখি।
একটা কিছু এদিক থেকে ওদিক হতে দিই না। আষ্টেপৃষ্ঠে কেউ আমাকে যেন এই রুটিনে বেঁধে
ফেলেছে। আমিও কখনও নিজেকে মুক্ত করার উপায় খুঁজিনি। বরং এই বাঁধনই আমার
ভালো লাগে।
একদিন আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দেখতে পেলাম চামড়ায় কত শত ভাঁজ পড়ে গেছে। ভালো করে লক্ষ করলাম। দেখলাম সারা
শরীর জুড়ে ভাঁজে ভাঁজে কিছু লুকিয়ে। কেন চোখে পড়েনি আগে এগুলো! প্রতিদিন তো
দাঁড়াই এই আয়নাটার সামনেই! উত্তর খোঁজার
চেষ্টা শুরু করলাম।
সেদিন সকালে ছেলেকে বলেছিলাম, আমার শরীর
খারাপ লাগছে। একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।
ছেলে বলল, আমার ইমপরট্যান্ট মিটিং আছে।
প্লিজ ম্যানেজ।
মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কাছেই থাকে। ফোনে
বললাম ওষুধ এনে দিতে। শুনে বলল, আজ অফিসের অনেক কাজ আছে। প্রেজেন্টেশন! কী করে
যাব!
ফোন রেখে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। ঘুমের
ওষুধগুলো হাতে নিয়ে দরজা খুললাম। সামনে একটা ঠান্ডা রাস্তা। ভীষণ ঠান্ডা! মনে হল সেই
রাস্তায় গেলে সব যন্ত্রণার অবসান। পা ফেলতে যাব, কেউ একটা বলে উঠল ওই রাস্তায় যাওয়ার আগে
একবার ভালো করে নিজের দিকে তাকাতে। আর সেই জন্যই আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে
ভালো করে লক্ষ করছিলাম। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে যেগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম সেগুলো আসলে
অন্য কিছু নয়। আমার জীবনের ফেলে আসা তিরিশটা বছর। যেন অন্য একটা রাস্তার সন্ধান
পেলাম। ঘুমের ওষুধগুলো রেখে ঠান্ডা রাস্তার দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এবার
নতুন রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে দিলাম। বুঝতে পারলাম, এই নীল গ্ৰহে অন্তত কিছুটা স্বার্থপর হওয়া
কতটা জরুরি।
বদল
কাল সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না কাজলের। অফিসের কাজ করতেও
বেশ রাত হয়েছে। তাই বিছানার মোহ ত্যাগ করতে ইচ্ছা করছিল না একদম। কিন্তু একটা ইমপরট্যান্ট
মিটিং আছে। অগত্যা উঠতেই হল। রেডি হয়ে নীচে এল। জল ঢালতে ঢালতে সরোজকে বলল, তোমার হয়েছে? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
গো।
রান্নার লোক থাকলেও আজকাল ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে
বানাতে ভালোবাসে সরোজ। কাজলের কথা শুনে সরোজ বলল, এই তো হয়ে গেছে!
স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে ব্রেকফাস্ট
করতে করতে কাজল বলে, তিন্নি কাল আমাকে ওর হোমওয়ার্ক চেক করে দিতে বলেছিল। একদম সময় পাইনি। অফিসের এত চাপ! তার ওপর শরীরটাও...
—তুমি ভেবো না। আমি চেক করে দেব।
তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের জন্য বেরিয়ে
যায় কাজল।
বাড়ি থেকে বের হতেই পেছন থেকে ডাক, কাজল কাজল। একটু দাঁড়াও।
—হ্যাঁ বলো বউদি!
—কী ব্যাপার! তুমি একা! সরোজ অফিস যাচ্ছে
না?
—না বউদি। ওর অফিসে বেশ ঝামেলা চলছিল। আমিই বললাম চাকরিটা
ছেড়ে দিতে।
—কিন্তু...
—ওর মন যেটা ভালোবাসে করুক। চলি।
কাজল তাড়াতাড়ি পা চালাল।
সন্ধেবেলা কাজল অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে এক গ্লাস ঠান্ডা জল এগিয়ে
দেয় সরোজ। বলে, শরীর কেমন?
—ঠিক আছি।
—জানো তো কাজল, আজ একটা অণুগল্প লিখলাম। তিন্নিকে শুনিয়েছিলাম। ওর বেশ লেগেছে।
—তাই! আমাকেও শুনিও প্লিজ।
—অবশ্যই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর
শোনাব।
তিন্নি দৌড়ে এসে কাজলকে জড়িয়ে ধরে বলে, জানো তো মা, বাবা গল্পটার শেষটা
দারুণ লিখেছে।
কাজল সরোজের হাতের ওপর হাত রাখে। একটা প্রজাপতি উড়ে
যায়।
তিনটি অণুগল্পই বেশ ভাল লাগল
ReplyDelete