প্রণব চট্টোপাধ্যায়
(৪ অক্টোবর, ১৯৫৫ — ১৯শ
জানুয়ারি, ২০১৮)
প্রকাশিত বই:
কবিতা:
রাজার চালচিত্র
সজনে পাতার চারিদিকে
ছোটছোট তীর
ভাষা-জন্ম
ঘোড়া সিরিজ
বলছি, মায়ারাত্রির কথা
দেশপ্রিয় পার্কের সেই মন্টু
প্রয়াণের শঙ্খধ্বনি
অন্য:
বাঁকুড়া জেলার পত্রপত্রিকা
কাব্যোপন্যাস (অগ্রন্থিত) :
ধাতব হাওয়াজাহাজের গায়ে পাখির শরীর
গল্প (অগ্রন্থিত):
যমপট
অমানবিক
সম্পাদিত পত্রিকা: হেমলক
থাকতেন বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে।
………………………………………………………………………………..
আনন্দ
একা একা নষ্ট করি
আমার আয়ু।
‘মায়াবন বিহারিণী’ বলে
উপুড় করি আমার গান
ক্ষয়াটে চাঁদকে বলি,
আরও মায়া দাও।
হরিণের মতো
দৌড়ে যাচ্ছে এই প্রকৃতির
দারুণ আলো...
আমি এসব আমার গানে–
এনে এনে রাখছি।
এই দ্যাখো রঙিন পর্দার মতো
এখনও দুলছে,
এই আমার হৃদয়।
ভাষা-জন্ম
১
এই মাটি যদি ভেদ করি
কপালে তিলক এঁকে দিও
সীতার দেশের ছেলে তুমি,
ধুলা পায়ে, খুঁজো রামপ্রসাদ।
শোন, ওই রামপ্রসাদের ঘর থেকে
এখনো ভেসে আসে
আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের গান।
ভাষা-জন্ম
২
কাটুম-কুটুমের হাত আরো শক্ত হ’ল
মাথার ভিতরে সামনে বইছে সবুজ হাওয়া।
এমন আপৎকালে, একটানা চিৎকার করি–
আমার গর্ভগৃহ কোথায়?
কোথাও কোনো শব্দ নেই, সুনসান, দেখি–
এক মাঝি জলে নৌকা ভাসিয়েছে।
ভাষা-জন্ম
৬
কোন তীরে একে গেঁথে ফেলবে?
ভেদরেখা, সীমারেখা এখনও ঘন কুয়াশাময়,
জড়িয়ে থাকে পুরাণ পর্বের ঋণ,
এক আঁধার-পাখি, এই অরণ্যে চেয়ে থাকে
রাখাল-বালকের চোখ দিয়ে
সেই অরণ্যে আলো হয়।
কেন তীরে একে গেঁথে ফেলবে?
ভেদরেখা, সীমারেখা এখনও ঘন কুয়াশাময়।
সজনে পাতার চারদিকে
সজনে পাতার চারিদিকে
রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে।
দূরের চাঁদ, আরো কাছে চলে এল,
খুবই লোভ তার, কাছ থেকে
ওইসব প্রজাপতিদের দেখার।
রাজা
হুকুম, আমার হুকুম, সব ব্যাপারেই
নীচু থাকুন।
যখন যাবার তখন যাবেন
এখন শুধু পাতার বাতাস করতে আসুন...
হুকুম, আমার হুকুম, গ্রাম-গঞ্জ
জ্বালিয়ে দিয়ে
ফিরে আসুন, আর ফিরে এসে–
লম্বা করে, সেলাম এবার ঠুকুন, হুকুম,
আমার হুকুম।
রাজার চালচিত্র
চন্দ্রাতপের নীচেই তুমি,
হাসিতে, গাম্ভীর্যে, শলা-পরামর্শে
পাশে থাকে মন্ত্রী,
‘ভালবাসা’ মনে এলে, দেউড়িতে
উঁকি দ্যায় রানী,
এই শুধু; এর পরে , তোমার পিছনে ছায়ার
মতো দুঃখে, সংকটে এসে হাজির,
স্মরণ করুন হুজুর,বান্দা হাজির,
এই শুধু: নর্তকী, খাজাঞ্চী, সৈন্য,
প্রহরী,
এরা তো থাকে, এই নিয়েইতো, তুমি
রাজা।
রাজধানী ঘিরে, দুর্গের প্রহরায় থাকে
ওই রাজার চালচিত্র।
বন্যা
খুবই কাছের নদীগুলি আর নদী নয়
যেন
উত্তাল সমুদ্র হয়ে গেছে।
কবি
এই চাঁদের পিছনে-পিছনে
গিয়ে, এই কবি একেবারে মরে যায়,
আর ওই চাঁদ, তার আলো দিয়ে
কবিকে ‘দাহ’ করে।
ঘোড়া সিরিজ
৮
দু’টি ঘোড়ার জিভ, চুম্বনে
আকৃষ্ট হ’ল, পায়ের ওই পেশিগুলি
যেন বনজ শিকড়মালা ।
এই চুম্বনে, পৃথিবী খুব কাছে
ঘুরে এলো, দেখি, দুটি ঘোড়া
হ্রেষা দিয়ে, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে।
ঘোড়া সিরিজ
১২
এক কামুক ঘোড়ার ভিতরে বসে বাৎস্যায়ন পড়ি,
পড়ি, নানান স্তনের কিসসা, নিতম্বের
ছিরি-ছাঁদ
শঙ্খিনী, পদ্মিনী, হস্তিনীর নিতম্বের
ঢালে,
কীভাবে কাত হয়ে যায় চোখ ।
পড়ি, মৃদু-মৃদু শীৎকার-ভাষ্য,
আর কঁকিয়ে-কঁকিয়ে উঠি আমি ।
খ্যাপা! আমি মাটি চষে চষে মাঠ বানিয়েছি,
আর কিনা, আমাকে নিয়েই, কামুক ঘোড়া
সেই কামগুরু বাৎস্যায়নের পত্নীর খোঁজ করে।
ঘোড়া সিরিজ
১৪
ভিতরে থাকলাম - আমি
ভিতরে থাকল, এই আমার হ্রেষা
ভিতরে থাকল, এই আমার উত্থিত লিঙ্গ।
ঝরাতে থাকলাম – বীর্য
ঝরাতে থাকলাম – শিহরণ
ঝরাতে থাকলাম – কাম-ফুল
ঝরাতে থাকলাম – সৃষ্টি।
বলছি, মায়ারাত্রির কথা
৪
এই বেদীর একটা ডাকনাম আছে;
পিশাচসিদ্ধ বেদী। ভয়ে মানুষেরা স্থান ছাড়ে।
এই জীবনে, ইহকাল-পরকাল বলতে কিছু নেই,
নৌকোর মাঝি এলে দাঁর কেড়ে নিই–
বলি, পারলে গলুই-এ স্থির হয়ে বসো তো দেখি,
এমনকী তাকেও স্তোকবাক্যে বশ করি,
বলি, এই তমসায়, তুমি একা থাকবে
কীভাবে?
তোমার তো জীবন্ত মুণ্ডুটাই উড়ে যাবে,
বাকি জীবনটা কবন্ধ হয়ে, এখানে-সেখানে
ঘুরে বেড়াবে, এই দ্যাখো,তোমার
চোখে
কোনও স্থির ছায়া নেই,
পারলে, এখুনি পিঠ্টান দাও।
এই দ্যাখো, আমার নেই ইহকাল-পরকাল,
শুধু গৈরিক বস্ত্রকে শরীরে জড়িয়ে,
যেন অনন্তকাল ওই ভৈরবীকে,
এক সূর্য ভেবেছি।
বলছি, মায়ারাত্রির কথা
১২
নৌকোটিকে, জল কেটে আরও গভীরে নিই।
মুরশিদ তখন ওই পাকদণ্ডী বেয়ে
আরও উপরে উঠেন, আর আমরা বলি, বদর-বদর।
পঞ্চমুণ্ডীর আসনে এক ভৈরব আসীন,
তার ওই উত্থিত লিঙ্গের ভেতরে তখন নাম-গান,
লাল চোখের এক ময়ূর,
যেন ভৈরবের চোখে ক্রমাগত পেখম মেলছে...
ভৈরবীও তার গেঁজাল চোখে-
রাত-দিন এক করে চলে, বলে, ‘সোহম’
নৌকোটিকে, জল কেটে আরও গভীরে নিই।
দেখি, লিঙ্গের ভেতর দিয়ে, ক্রমশ এক
ভোর আসছে।
সমর্পণ
মন্ত্রটিকে ঠিক ঠিক ভাবে উচ্চারণ করছি বলে
হোমের কাঠগুলি লাল হচ্ছে; তারপর
ছাইয়ের শরীর নিয়ে, হোম-কুণ্ডের নীচে পড়ে থাকছে ।
দূরে তো দেখছি, একটি নৌকা
ওই মনোরম জলে ভাসছে ...
মাঝির গানেও তো এক মন্ত্র উঠে আসছে –
প্রাণ-কুণ্ডে ক্রমশ লাল হচ্ছে ;
আর ঢেউ হয়ে শুধু দোল খাচ্ছে ...
হৃদয়-মাঝির মায়াবী ইশারায়,
এখন আমিও ভুলে যাচ্ছি ঠিকভাবে সেই মন্ত্রের উচ্চারণ !
আমাকে গ্রহণের জন্য
এক আগুন-ভরা নারী,
একটু-একটু করে বিছিয়ে দিচ্ছে
তার ওই সুন্দর
যৌনাঙ্গ।
প্রণত হলাম। লেখাগুলির কাছে। তোমাকেও ধন্যবাদ অনিন্দ্যদা।
ReplyDeleteঅনিন্দ্য, প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠে আমার মুগ্ধতা এই হেমন্ত সকালের রোদ হয়ে ফুটে থাকল। কবিতা নিয়ে তোমার যে অন্বেষণ আমাকে বরাবর আগ্রহে রাখে।
ReplyDeleteছোট ছোট আলোর আগুন।
ReplyDeleteমুগ্ধতা।
ReplyDelete