বাক্‌ ১৫০ ।। রোহন রায়

মানব-বোমা

 

হ্যালো?

হ্যালো, তুষারবাবু বলছেন?

হ্যাঁ। আপনি?

নমস্কার তুষারবাবু। জানি আপনি এখন ব্যস্ত। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছেন। আসলে আমার কথাটা খুব জরুরি, তাই বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম।

আপনি কে বলছেন?

সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হচ্ছে, আপনার খুব বিপদ।

কীসের বিপদ? আপনি কে বলছেন বলুন তো?

পরিচয় দিতে পারব না, মাফ করবেন। আমি আপনাকে সাবধান করতে ফোন করেছি। আপনার কিন্তু সত্যিই চরম বিপদ।

সাতসকালে ইয়ার্কি হচ্ছে? ইডিয়ট কোথাকার!

আমি একটুও ইয়ার্কি মারছি না। আমার কথাটা মন দিয়ে শুনুন প্লিজ। বিপদ কিন্তু যে কোনও দিক থেকেই আসতে পারে। আপনার বর্ধমানের বাড়িতে এখন কী ঘটছে আপনি জানেন? দুলালবাবু, মানে আপনার বাবা এখন বাজার করতে বেরিয়েছেন। পথে ভালোমন্দ কিছু একটা ঘটে যেতেই পারে। তারপর ধরুন, আপনার মা এখন বাড়িতে একা, সেলাই করতে বসেছেন। একতলার ঘর। জানলা তো খোলাই থাকে। একটা লোক যদি এসে গুলি চালিয়ে দিয়ে চলে যায়?

চ্যাংড়ামো হচ্ছে? পুরকি বার করছি, দাঁড়াও! নম্বরটা এখনই পুলিশে দিচ্ছি।

এক মিনিট। অত ব্যস্ত হবেন না। আমার কথাটা শুনুন, তারপর আপনার যা মনে হয় করবেন। আপনার ঘরে যে হলুদ ওয়ারড্রোবটা, তার মাথায় একটা শ্বেতপাথরের রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে তো?

কী করে জানলি? তুই কে বল তো?

ছিঃ! অপরিচিত কাউকে তুই-তোকারি করতে আছে? আপনি ওই মূর্তিটার দিকে তাকান। ওটা এখনই উড়ে যাবে।

অ্যাঁ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। ঘাবড়াবেন না কিন্তু। আর ভুল করেও ফোন কাটবেন না। দেখুন। ওয়ান, টু, থ্রি, বুম!

মাই গড!

দেখলেন? বলছিলাম না আপনার খুব বিপদ? এটা স্নাইপারের গুলি।

স্নাইপার!

হ্যাঁ। আরও নানারকম ব্যবস্থা আছে আমাদের। আপনি আন্ডার সারভেলান্স। আপনার থেকে একশো বারো কিলোমিটার দূরে আপনার পরিবারও আমাদের নজরবন্দি। এবার বলুন, পুলিশে ফোন করবেন নাকি আমার কথা শুনবেন?

দাঁড়ান। আমার বুকটা কেমন করছে।

বেশি দাঁড়ানোর সময় নেই তুষারবাবু। অনেক কাজ।

কী চান?

খুবই সামান্য চাহিদা আমাদের। যা যা বলছি পরপর সব করে যান। প্রথমে ব্লুটুথ ইয়ারপ্লাগটা কানে লাগিয়ে নিন। আমি এখন বেশ কিছুক্ষণ ফোনকলে থাকব আপনার সঙ্গে। আপনাকে নির্দেশ দেব, আপনি সেভাবে কাজ করে যাবেন। ঠিক আছে? কী হল, বসে রইলেন কেন? হারি আপ। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

লাগিয়েছি।

হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন তো?

পাচ্ছি।

থ্যাঙ্ক ইউ। লেটস স্টার্ট। চেক করুন ওয়ালেটে কত টাকা আছে। খুচরো বাদ দিন, শুধু বড় নোট গুনলেই হবে।

পাঁচ হাজার তিনশো

ওতেই হয়ে যাবে। আপনি তো রেডি হয়েই আছেন। শুধু জুতোটা গলানো হয়নি। গলিয়ে নিন। নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ুন। অফিসের ব্যাগ নেবার দরকার নেই। আজ আপনি অফিস যাচ্ছেন না।

কোথায় যেতে হবে?

প্রশ্ন করবেন না। যা বলছি করে যান। ঘর লক করে নীচে নামুন।

এবার?

গেটের বাইরে দেখুন একটা হলুদ ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। পিছনের সিটে উঠে পড়ুন।

কোথায় যেতে হবে?

সেটা দেখতেই পাবেন। সিটের ওপর দেখুন একটা কালো পিঠব্যাগ আছে। পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

নামার সময় ওটা পিঠে নিয়ে নেবেন। সাবধানে নাড়াচাড়া করবেন। জিনিসটা বিপজ্জনক।

কী জিনিস?

আপনি যা ভাবছেন তাই।

আমার বুকটা কেমন করছে!

ধুর মশাইএই বয়েসে হার্ট এরকম উইক হলে চলে?

আমি কী করেছি? আমাকেই কেন টার্গেট করলেন আপনারা?

এত প্রশ্ন কেন করেন? আপনি কি প্রশ্ন বিচিত্রা? সময় হলে সব জানতে পারবেন। আচ্ছা শুনুন, আপনার যদিও মিষ্টি তেমন পছন্দ নয়, তবু জিগ্যেস করছি, আপনাদের এখানকার সেরা মিষ্টির দোকান কোনটা?

আমি মিষ্টি পছন্দ করি না সেটাও জানেন?

জানতে হয়। পার্ট অব প্রফেশন। বলুন না এখানে সবচেয়ে ভালো মিষ্টির দোকান কোনটা।

শ্রীদুর্গা। বা আনন্দময়ী।

ইশশ্‌আচ্ছা, কালিকা খুব খারাপ নয় তো?

কালিকা? না, ভালোই।

স্যাড লাগছে। আগে জানলে শ্রীদুর্গা বা আনন্দময়ীতেই ব্যবস্থা করতাম।

কীসের ব্যবস্থা?

মিষ্টির, আবার কীসের? এই যে আপনার গন্তব্য এসে গেছে। নেমে পড়ুন। ব্যাগটা নিতে ভুলবেন না। সামনেই দেখুন কালিকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

হ্যাঁ।

ঢুকে যান।

মিষ্টির দোকানে কেন ঢুকব?

ওরা একটা বড় বাক্সে আপনার জন্য পাঁচশো টাকার কালাকাঁদ সরিয়ে রেখেছে। টাকা দিয়ে বাক্সটা নিয়ে নিন।

এর মানেটা কী?

নিন না। পরে বলছি। ইচ্ছে হলে আপনিও দু’-একটা চাখতে পারেন। তবে আলাদা নেবেন। বাক্স থেকে খাবেন না প্লিজ।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আপনার কিছু বোঝার তো দরকার নেই। যা বলছি করে যান। আরে আরে, উল্টোদিকে কেন যাচ্ছেন? বলছি না আপনি আন্ডার সারভেলান্স? কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে লাভ নেই। আমাদের আপনি দেখতে পাবেন না। কিন্তু আমরা আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের তিনজন লোক সারাক্ষণ ছায়ার মতো লেগে আছে আপনার সঙ্গে। ওদিকে আপনার বাবা-মায়ের সঙ্গেও একজন করে লোক ফিট করা। আর তাছাড়া আপনার পিঠে কী রয়েছে জানেন তো? আমি একটা বোতামে চাপ দিলেই আপনি তুবড়ি হয়ে যাবেন।

আমাকে কেন এরকম টর্চার করছেন? আমি কী করেছি?

কাঁদছেন নাকি? কান্নাকাটি করে লাভ নেই। লক্ষ্মী ছেলের মতো আমাদের কথামতো চলুন, কোনও ক্ষতি হবে না। দোকানে যান। বাক্সটা নিন। আমি অপেক্ষা করছি।

নিয়েছি।

ভেরি গুড। এবার বেরিয়ে আসুন। দেখুন সামনেই একটা সাদা এসইউভি দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পেয়েছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু গাড়িটায় একজন প্যাসেঞ্জার বসে আছেন।

ওই গাড়িটাই। আপনি সামনে উঠুন। ড্রাইভারের পাশে।

কিন্তু এই লোকটা কে?

উনি প্যাসেঞ্জার নন। আপনার ওপর যাঁরা নজর রাখছেন, উনি তাঁদের একজন। ওনার পকেটে একটা কিয়াপা রাইনো রিভলভার রয়েছে। ইটালিয়ান মাল। পয়েন্ট থ্রিফাইভসেভেন ম্যাগনাম। তিরিশ মিটার দূর থেকে মারলেও এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনি কোনওরকম বেগড়বাঁই না করলে উনি ওটা বের করবেন না।

প্লিজ আর ভয় দেখাবেন না। আমি কিছু করার অবস্থায় নেই।

থ্যাঙ্ক ইউ। একটু জল খান। বেটার ফিল করবেন। ড্রাইভারের কাছে জল পাবেন।

একটা কথা জিগ্যেস করব?

করুন।

বুঝতে পারছি আপনারা কোনও বড়সড় বম্ব ব্লাস্টের প্ল্যান করছেন। কিন্তু আমিই কেন? আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।

ক্রমাগত এক প্রশ্ন করে বিরক্ত করবেন না। আপনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করছি না। কাজটা হয়ে গেলেই ছেড়ে দেব। ততক্ষণ প্লিজ একটু সহযোগিতা করুন।

আমি ফেঁসে যাব না তো? আপনাদের কথামতো কাজ করলে আমার কোনও রিস্ক থাকবে না তো?

না। নিশ্চিন্ত থাকুন।

প্লিজ দেখবেন আমি যেন ফেঁসে না যাই। আপনারা যা বলবেন আমি করব।

আচ্ছা তুষারবাবু, আপনি তো রিবকের জুতো পরে আছেন। এছাড়াও একজোড়া করে নাইকি আর পুমা আছে আপনার। কোনটা বেটার?

আমার কী কী জুতো আছে সেটাও আপনারা জানেন?

জানতে হয়। এটাই আমাদের পেশা। কোনটা বেটার বলুন না।

আমার রিবক বেটার লাগে। নাইকিও বেশ ভালো।

উডল্যান্ডের জুতোর ব্যাপারে আপনার কী মতামত? কখনও ব্যবহার করেছেন?

করেছি। উডল্যান্ড ভালো। খুব হার্ডি।

লোকে বলে উডল্যান্ডের জুতোকে মারণাস্ত্র বললেও নাকি ভুল বলা হয় না।

ঠিক।

বেশ বেশ। আচ্ছা দেখুন, গাড়িটা এবার উডল্যান্ডের শো-রুমের সামনে থামবে। নেমে যান। মিষ্টির বাক্সটা নিয়ে নামবেন।

এবার কি জুতোর দোকানে ঢুকতে হবে?

ঠিক ধরেছেন। ওখানে আপনার জন্য একজোড়া লেস-আপ বুট প্যাক করা আছে। বিল করা হয়েছে বি. দত্ত নামে। গিয়ে তুলে নিন। চারহাজার সত্তর টাকা পে করবেন। ক্যাশে।

মিষ্টির পর জুতো! কী হচ্ছে এটা?

সময় হলেই বুঝতে পারবেন। চটপট করুন। আমি অপেক্ষা করছি।

নিয়েছি।

ধন্যবাদ। এবার বেরিয়ে আসুন। রাস্তা পেরোন। সামনে ডানদিকে আদ্যা মা লন্ড্রি দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

লন্ড্রির সামনে দেখুন একটা অটো দাঁড়িয়ে আছে। অটোর পিছনে মা কালীর ছবি।

হ্যাঁ পেয়েছি।

উঠে পড়ুন। সামনে বসবেন।

এখানেও একজন বসে রয়েছেন দেখছি। ইনিও কি আপনাদের লোক?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আজকের ওয়েদারটা কিন্তু বেশ রোম্যান্টিককী বলেন? বেশি রোদ নেই, আবার পুরো মেঘলাও না। এরকম দিন বম্ব ব্লাস্টের পক্ষে একেবারে উপযুক্ত। বুঝলেন?

না।

নাশকতাও যে একটা মস্ত বড়ো শিল্প এটা সকলে বোঝে না। খুবই দুঃখের কথা। যাক গে, অটো এবার গড়িয়া বাজার ছাড়িয়ে মহামায়াতলার দিকে যাচ্ছে। চিনতে পারছেন তো?

পারছি।

ওইদিকে তো আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়ি?

সবই জানেন দেখছি।

জানতে হয় স্যার। আপনাদের চার বছরের প্রেম তো? এ বছর এপ্রিলে বিয়ে হবার কথা ছিল?

এসব কথা কেন উঠছে?

মেয়েটার মুখে অ্যাসিড লাগল বলে বিয়েটা ভেঙে দিলেন? এই আপনার ভালোবাসা?

তার সঙ্গে আপনাদের কাজের কী সম্পর্ক? এত পার্সোনাল কথার জবাব আপনাদের দেব কেন আমি?

দেবেন, কারণ আপনি এখন একটি মানব-বোমা। আর আপনার পিছনে যিনি বসে আছেন, তার পকেটে রয়েছে একটা নাইন এমএম পিস্তল। পয়েন্ট ব্ল্যাংক থেকে গুলি করলে ঘিলু ছিটকে বেরিয়ে পুরো অটো মাখামাখি হয়ে বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে। তাছাড়া আপনার মা-বাবাও...

সরি। আই অ্যাম সরি। ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ কিছু করবেন না।

উত্তরটা দিন। একটা দুর্ঘটনায় উবে গেল আপনার ভালোবাসা? বাইরের রূপটাই আসল হল?

জানি না। আমি জানি না। আমি এখনও মনীষাকে ভালোবাসি। কিন্তু ওরকম বীভৎস মুখ

ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দ ভুলেও আর উচ্চারণ করবেন না তুষারবাবু। আপনার কুৎসিত মুখে ওই শব্দটা মানায় না। এই কঠিন সময়ে মনীষার সবচেয়ে বেশি করে দরকার ছিল আপনাকে। আপনজনদের অকুণ্ঠ সাপোর্ট পেলে তবেই এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আপনি কী করলেন এটা?

আমি চাইলেও আমার বাড়ির লোক মেনে নেবে না। বিশ্বাস করুন।

তাঁরা তো মনীষাকে ভালোবাসেননি। ভালো তো আপনি বেসেছেন। বাড়ির লোককে বোঝানোর দায় তো আপনার ছিল।

আমি পারব না। আমি পারব না।

পারতে আপনাকে বলছিও না। আপনি কী ভেবেছেন, আপনি যদি এখন বোমা-বন্দুকের ভয়ে মনীষাকে বিয়ে করতে চান মনীষা রাজি হবে? ওকে বিয়ে করার যোগ্যতা নেই আপনার। শুধু ওকে কেন, আপনি কাউকেই বিয়ে করার যোগ্যতা রাখেন না। কোনও নারীর ভালবাসা পাবার যোগ্যতা নেই আপনার। যে জানোয়ারটা মনীষাকে অ্যাসিড ছুঁড়েছে, আপনার অপরাধ তার থেকে সামান্যই কম।

আপনি কি মনীষার কেউ হন?

সেটা জেনে আপনার লাভ নেই। অটো এবার মনীষাদের বাড়ির গলিতে ঢুকছে। নামুন।

কী করতে হবে প্লিজ একটু বলবেন?

এমন কিছু না। বেল বাজাবেন। মনীষা বাড়িতেই আছে। প্রথমে ওর হাতে জুতোর বাক্সটা দেবেন। ও আপনাকে আচ্ছা করে জুতোপেটা করবে।

প্লিজ। এটা না করলেই কি নয়?

না করলেই নয়।

ক্ষমা করুন। প্লিজ।

এরকম ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবেন না। বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে। আর শুনুন, জুতো খাওয়া হয়ে গেলে হাসিমুখে মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে মনীষাকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানাবেন। আসছে চব্বিশে ফাল্গুন ওর বিয়ে।

বিয়ে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আপনিই তাহলে সেই লোক?

যদি হইও, আপনি কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না। বেল বাজান। চটপট।

 

No comments:

Post a Comment