অশ্বমেধের ঘোড়া
(১)
ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক। এক নামজাদা লেডি ডক্টর যার নামের পরে
অনেকগুলো দেশি বিদেশি ডিগ্রি, তিনিই এই ক্লিনিক চালান। গত কয়েক বছর ধরে এই
ডাক্তারম্যাডাম খুব নাম করেছেন। টিভি থেকে শুরু করে খবরের কাগজ এবং মাসিক
পত্রিকাগুলোতে তাঁর অনেক ছবি ও ইন্টারভিউ ছাপা হয়। কলকাতার নামজাদা প্রথম
পাঁচজন ইনফার্টিলিটি স্পেশালিস্টদের মধ্যে ইনি একজন।
ম্যাডামের বয়স কিছুতেই চল্লিশের ওপর হতে
পারে না। চেহারা সুশ্রী। নিজের সৌন্দর্যের দিকে যে তাঁর যত্ন আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়। ববকাট চুল। হালকা বার্গান্ডি রং করা। মুখে
হাসি কম। তবে চেহারার লাবণ্য তাঁর দিকে তাকালে একটা
মানসিক স্নিগ্ধতা এনে দেয়। ইংরিজিতেই কথা বেশি বলেন। বাংলা বললেও সেটা টেনে টেনে
অবাঙালিদের মতো উচ্চারণ করেন।
পোশাক, চুলের রং এবং কথার ধরনে একটা বিদেশি কেতা আনার চেষ্টা করেন। তবে ভালোভাবে লক্ষ করলে
ম্যাডামের অভিনয়টা বোঝা যায়। যাই হোক তাঁকে অনেক অবাঙালি রুগি দেখতে
হয়। তাঁর কাছে চিকিৎসার যা খরচ তা সাধারণের সাধ্যের বাইরে। তাই
মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের রুগি তাঁর কম। ম্যাডামের সেই ভেক
তাই তাঁর বেশিরভাগ রুগিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।
আমাদের দুই চরিত্র কলকাতার বাসিন্দা। ছেলেটি
কর্পোরেট সেক্টরে খারাপ মাইনের চাকরি করে না। তবে পারিবারিক সাহায্য তেমন কিছু
নেই। উলটে দায় আছে কিছু। মেয়েটি চাকরি করে না। কলকাতায় ফ্ল্যাট ভাড়া করে থেকে
গাড়ির লোন শোধ করতে করতে হাতে বিরাট কিছু উদ্বৃত্ত থাকে না। তার মধ্যে আগের দু’বার চেষ্টা করেও মেয়েটির সন্তান আসেনি।
সেই দু’বারই চিকিৎসার পুরো খরচ জলে গেছে। এবার তাই তারা শেষবারের
মতো একবার চেষ্টা করবে এমনই কিছু মনস্থ করে এসেছে।
আগের দু’বার তারা এই
ম্যাডামের কাছেই চিকিৎসা করিয়েছে। মেয়েটি বলেছিল এবার অন্য কোনো ডাক্তারবাবুর কাছে
যাবার কথা। কিন্তু ছেলেটি রাজি হয়নি। কারণস্বরূপ মেয়েটি বলেছিল তার স্বামী বোধহয় ম্যাডামের
প্রতি কিছুটা অনুরাগে আক্রান্ত। সে রসিকতা করেই বলেছে। কথাটা যদিও খুব মিথ্যে
নয়। ম্যাডামের দুর্লভ হাসিটি কদাচিৎ মুখে ছড়িয়ে গেলে তার কুচিকুচি দাঁতগুলো এত
সুন্দর দুই সরু ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তাই দেখলে তার প্রথম প্রেমের
কথা মনে পড়ে। যদিও এই কথা যুবকটি মেয়েটির কাছে গোপন রেখেছে।
তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক বাইরে বসে
অপেক্ষা করছিল। চারপাশে খুব সুন্দর বাচ্চাদের ও মায়েদের ছবি। বেশিরভাগ ছবিই বিদেশি
মায়েদের। বাচ্চাদের ছবি দেখেও মনে হয় না তারা কেউ ভারতীয়। সৌন্দর্য একটি বিদেশি
জিনিস। বিদেশি সাবান বা সুগন্ধীর মতো— সেই ছবিগুলো দেখলে
আপনার তেমনই মনে হবে। বসার ঘরে হালকা করে সেতারের রেকর্ড বাজছে। তারা কেউ ধ্রুপদী
সঙ্গীতের ভক্ত নয়। তাই কী রাগ বাজছে তা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যুবকটি ভাবছে
জানলে ভালো হত। সে অনেকবার ভেবেছে একা একাই শুনে শিখবে। চেষ্টা বেশিদূর এগোতে পারেনি।
তবে এটা শুনে কেন জানি তার মনে হল বোধহয় নিখিল ব্যানার্জি।
তাদের এই মুহূর্তে সেদিকে খুব মন নেই। মনে
উৎকণ্ঠাই বেশি জমা হয়ে আছে। তারা তৃতীয়বারের মতো বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার
সাইকেল শুরু করতে চলেছে। যদিও গত দু’বারের অভিজ্ঞতা থেকে
তারা জানে তাদের পরপর কী কী করতে হবে। কিন্তু আগের দু’বার চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ায় এবারে তারা কিছুটা বেপরোয়া। যুবকটি তার এক পরিচিতের
কাছে বেশ কিছু টাকা ধার করে এবারের চিকিৎসা করাচ্ছে। এবার ব্যর্থ হলে আর হয়তো এই
রাস্তায় আসা সম্ভব নয়।
তারপর দু’জনেরই বয়স প্রায়
সাঁইত্রিশ। ছেলেটির পক্ষে বাবা হবার বয়স তেমন বেশি না হলেও মেয়েটির ক্ষেত্রে তেমন
বলা যায় না। তার ওপর শারীরিক ও মানসিক যত ধকল সব মেয়েটিকেই বেশি সহ্য করতে হয়। এর
ফলে গত কয়েক বছরে তার মানসিক পরিবর্তন অনেক বেশি এসেছে। এখন যুবকটির মাঝে মাঝে তার
নিজের স্ত্রীকেও অচেনা মনে হয়। তার এক ডাক্তার বন্ধু বলেছে সবই নাকি হরমোন।
এমনও হয়েছে সে দু’দিন তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে যে কোনো কারণে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে এমন নয়। এমনি এমনি সে এমন মুখ করে থাকে যে মনে হয় না তার সঙ্গে কথা বলা যায়। জিজ্ঞাসা করলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। তাই সে চুপই থাকে। এর
জন্য সংসারের কাজের কোনো অসুবিধে হয় না। সে নীরব থেকেই স্বাভাবিকভাবে সব কিছু করে।
দু’দিন বাদে আবার সব ঠিকঠাক। কেউ দেখে বলবেই না দু’দিন ধরে তাদের এমন অবস্থা গেছে।
তারা এইজন্য কোনো ডাক্তারবাবুর কাছে যায়নি।
দু’জনেই বিশ্বাস করেছে একটা সন্তান এলেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক
হয়ে যাবে। যদিও দু’জনের এই বিশ্বাস নিয়েও তারা কেউ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেনি। তারা জানে ব্যাপারটা তাই। এই নিয়ে তাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই।
এবারের সাইকেলটা তাই তাদের পক্ষে খুব
গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকক্ষণ পার হয়ে যাওয়ায় ছেলেটি বারবার ঘড়ির
দিকে তাকাচ্ছিল। মেয়েটি অন্যদিকে তাকিয়েই বলল, জানো কাল রাতে না আমি একটা ঘোড়ার
স্বপ্ন দেখেছি।
ঘোড়ার?
হ্যাঁ, আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি। আমি
সারাজীবন সত্যিকারের ঘোড়া কখনও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। যা দেখেছি সব হয়
সিনেমায় নয় ছবিতে। অথচ ঘোড়াটিকে আমি এমনভাবে ছুটতে দেখলাম যেন আমি কতদিন ধরে
ঘোড়াটার সাথে আছি। আমিই যেন তার আস্তাবলের দেখাশোনা করি।
ইন্টারেস্টিং। আমাকে আগে বলোনি তো!
বলিনি। তুমি তো আবার এসবের নানান অর্থ বের
করো। ভেবেছিলাম আজ এখান থেকে ফিরেই তোমাকে বলব। কিন্তু কি হল হঠাৎ না বলে পারলাম
না।
তা বেশ ভালোই করেছ। যাই হোক আমি এটা শুনে
খুব আশ্বস্ত হলাম।
আমি এই কারণেই বলতে চাইনি।
আরে না না। তেমন কিছু নয়।
নার্স এসে যুবতীর নাম ধরে ডাকায় তারা
ম্যাডামের রুমে ঢুকল।
(২)
সাইকেল শুরু হবার সব প্রক্রিয়াগুলোই মেয়েটিকে বেশ কষ্ট দেয়।
ল্যাপারোস্কোপি বাদ দিলেও বারবার ইউএসজি করাতেও এখন যেন তার কষ্ট হয়। এই ক’দিনে এত ব্লাড দিয়েছে কিন্তু এখনও ব্লাড নিতে এলে সেই সিরিঞ্জ দেখলে তার ভয়
করে। সব ব্যথার অনুভূতিগুলো যেন তার হাতের শিরার চারপাশে এসে জমা হয়েছে। কয়েকদিন এমন
চিৎকার করেছে যে রক্ত নিতে আসা ছেলেটিও ভয় পেয়ে গেছে। সে বুঝতে পারে না হঠাৎ করে
কেন তার এমন ব্যথার অনুভূতিগুলো বেড়ে গেল।
সবচেয়ে ক্লান্তিকর মনে হয় হরমোন ইঞ্জেকশন
নেবার পর ম্যাডামের পরামর্শ মতো তিন-চারদিন ধরে
ধারাবাহিক শারীরিক মিলন। তার যখন বিয়ে হয়নি তখন আর পাঁচজনের মতোই যৌনতা নিয়ে তার অনেক কৌতূহল ছিল। কিন্তু যত দিন গেছে যৌনতা নিয়ে তার আগ্রহ আস্তে আস্তে উবে গেছে। এটা এমন নয় যে এই
ধারাবাহিক বন্ধ্যাত্ব এবং নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সে যৌনতার আনন্দ বা শিহরণ
বোধ করে না। এমনও নয় যে সে তার বরের সঙ্গে শারীরিক মিলন প্রত্যাশা
করে না। মেলামেশার সময় তার বেশ ব্যথা হয়। যুবকটি যত জোর করে তার ব্যথা তত বেড়ে যায়।
নিজে আনন্দ না পাওয়ায় সে ছেলেটিকেও খুশি করতে পারে না।
এমন নয় যে ছেলেটি তাকে শারীরিক আনন্দ দিতে
অক্ষম কিংবা তাদের বিবাহিত জীবন সুখের নয়। তবে সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে না তার
এই ব্যথার কারণ শারীরিক নাকি মানসিক।
মেয়েটি যখন কলকাতায় কলেজে পড়তে যেত তখন
লোকাল ট্রেনে আসা-যাওয়া করত। ওদের বাড়ি ছিল অশোকনগর। প্রচণ্ড ভিড় ট্রেনে লেডিসে অনেকদিন উঠতে না পারার জন্য কখনও জেনারেলে উঠতে হত। সেদিন
বনগাঁ লোকালে অস্বাভাবিক ভিড়। কোনোভাবে উঠে সে ভেতরে গিয়ে বেকায়দায় এক পায়ের ওপর
ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এত ভিড় ছিল ট্রেনে যে অন্যপায়ে তার জুতো পরা আছে কিনা সে তাও
বুঝতে পারছিল না।
সে খুব একটা লম্বা না। বেশ কষ্ট করেই ওপরে
হ্যান্ডেল ধরে একরকম প্রায় ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছিল। এমন সময় বোধ করল কে যেন তার
কামিজের ওপর হাত দিয়ে তার নিতম্বতে চাপ দিচ্ছে। তখন তার পিরিয়ড চলছিল। ওইরকম একটা
পরিস্থিতিতে যখন কারোরই মুখ দেখতে পারছে না, তার মুখটা চেপে আছে পাশের লোকটির ঘামে
ভেজা জামায়, পেছনের ওই জানোয়ার টানা কুড়ি মিনিট ধরে তার সঙ্গে ওই অসভ্যতা করে চলেছিল। তার নামার সময় যখন এল মুখ ঘুরিয়ে ভিড়ের স্রোতে নেমে
যাবার পরে সে স্টেশনে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে নেমে আসা কাউকে
দেখেই তার মনে হয়নি কেউ তার সঙ্গে এমন কাজ করতে পারে। জানোয়ারদের
বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
তার তখন একুশ বছর বয়স। এই ঘটনার পর থেকে কিছুদিন
সে সবকিছুতে কেমন যেন গুটিয়ে যেত। এই ঘটনার কথা সে যুবকটিকেও বিয়ের পরে একদিন বলেছিল। সে জানে
না এই কারণেই তার যৌনসুখ বলে কোনো বস্তু আদৌ হয়তো নেই। সে যে
মিলনে কোনো সুখ পায় না তাও ছেলেটিকে সরাসরি কোনোদিন বলেনি। তার মনে হয়েছে ছেলেটি হয়তো বুঝতে পারে।
ভেতরে ভেতরে এই অপরাধবোধটা সে গত ছ’ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। সেটা তার বন্ধ্যাত্বের চেয়ে কোনো
অংশে কম নয়।
চিকিৎসার জন্য যে শারীরিক মিলন সে আক্ষরিক
অর্থেই ভয়াবহ। যারা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন তারা জানেন। মেয়েটির নিজেকে তখন আক্ষরিক
অর্থেই দেহোপজীবি বলে মনে হয়। ছেলেটি যখন তার ওপরে উঠে নানা কসরত করে সে অন্যদিকে
মুখ ফিরিয়ে থাকে। কিছুতেই জেগে উঠতে পারে না। সে বোঝে এভাবে হয়তো ছেলেটির বিরক্তি খুব বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সে তার দিকে তাকাতে পারে
না।
বিছানার থেকে কিছুটা দূরে ড্রেসিং টেবিলের
যে আয়না আছে তাতে নাইট বাল্বের আলোয় তাদের ছায়া ফুটে ওঠে। মিথুনরত তার স্বামীর
ভঙ্গি দেখে কেন জানি আজ তার ঘোড়ার কথা মনে হল। মনে হল সে নিজে যেন সত্যিই এক ঘোড়া।
ছেলেটি তার ওপরে চড়ে বসেছে। ছেলেটির নগ্ন কোমরের আন্দোলন দেখে মেয়েটির নিজেকে ঘোড়া
বলে মনে হল। তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ছেলেটি সামনে-পেছনে দুলছে।
নিয়মমাফিক মেলামেশায় ছেলেটিও কোনো আনন্দ পায়
না। উপায় নেই। মেয়েটির শরীরেরও কোনো সাড়া নেই। স্তনদুটো ন্যাতপ্যাতে মাংসের দলার মতো মনে হল। ও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। কথা বললেও কোনো উত্তর দেয় না। সামনে দিকে
তাকাতে কাঠের ঘোড়ার মূর্তিটার দিকে তার চোখ পড়ল। ক’দিন আগে অফিস
থেকে আসার সময় ফুটপাথ থেকে কিনে এনেছে। ওর দিকে চোখ পড়তেই তার মনে হল এবার তাদের
সন্তান আসবেই। ঘোড়াটা সেই সম্ভাবনাই বহন করে এনেছে।
ছেলেটি মিলনের পরে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ
হল। ডাক্তার তাকে বলেছে মেলামেশার পর অন্তত আধঘণ্টা বিছানা থেকে না
উঠতে। ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে সে বিছানা থেকে উঠল। সম্পূর্ণ নগ্ন। উঠে ড্রেসিং
টেবিলের আয়নার পাশে বসল। কী বিকট দেখাচ্ছে তাকে! তার নিজেরই লজ্জা হল। এই কয় বছরে ওজন
অনেক বেড়ে গেছে। ভুঁড়িটা সামনে বেরিয়ে আছে। স্তনদুটো ঝুলে পড়েছে সামনে। চোখের নীচে
কালি।
সে একবার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল নগ্নতা
তার পছন্দ কিনা? সেসময় তাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে। সে অবধারিতভাবে বলেছিল নগ্নতার চেয়ে
সৌন্দর্য কিছু আছে নাকি! তার মনে হয়েছিল সে নতুন কামের ঘোরে এই কথা বলছে। তা তার
মনের কথা নয়। অন্তত এখন তার যা অবস্থা তাতে পোশাক-আশাকে নিজেকে না
ঢাকলে ডিপ্রেশনে পাগল হয়ে যাবে।
আয়নায় কাঠের ঘোড়াটা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি
বুঝতে পারছে না ছেলেটি প্রথম থেকেই তার ঘোড়ার স্বপ্ন দেখাটাকে এত কেন গুরুত্ব দিয়ে
দেখছে। ও অনেক তুকতাকে বিশ্বাস করে। তার হাতের পাঁচ রকমের আংটি বিয়ের পরপরই বানিয়ে
দিয়েছে।
এমন সময় রাতের সেই মায়াবী আলোয় সে দেখতে পেল
ঘোড়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এসে তার সামনে দাঁড়াল। সে পাশে ঘুরলে তার
বিরাট যৌনাঙ্গটা দেখতে পেল। এত বড় লিঙ্গ সে কোথাও দেখেনি। অবলীলায় ঘোড়ার পুরো
লিঙ্গটা সে তার যোনিতে ঢুকিয়ে নিল। সে অবাক হয়ে গেল তার যোনিতে এত জায়গা আছে দেখে।
তার মনে পড়ল ক’দিন আগে ঠিক সে এরকম স্বপ্নটাই দেখেছে। ছেলেটিকে সম্পূর্ণ
স্বপ্নের কথা লজ্জায় বলেনি। সে বুঝতে পারল তার যোনির ভেতরটা বহুদিন বাদে আবার ভিজে
উঠছে। আশ্চর্য সে এবার কোনো ব্যথাই পেল না। এত বড় অশ্বলিঙ্গ! অথচ কোনো ব্যথা নেই!
এ কীভাবে সম্ভব?
ঘোড়াটার মাংসল পেটের চাপে তার দমবন্ধ হয়ে
এল। নাকে এসে লাগল উৎকট গায়ের গন্ধ। মুখ খুলে শ্বাস নিতে গেলে মুখে গায়ের লোম ঢুকে
পড়ছে। দমবন্ধ অবস্থায় মুখ সরিয়ে নিতেই দেখল সে আয়নার সামনেই বসে আছে। অনেক দূরে শো-কেসের
ওপরে ছোট কাঠের ঘোড়াটা দেখা যাচ্ছে। কোথায় ঘোড়া, কোথায়ই বা তার লিঙ্গ? নিজের
মানসিক বিকৃতির জন্য তার লজ্জা হল। টয়লেট থেকে এসে ম্যাক্সি পরে ও বরের পাশে পাশ
ফিরে শুয়ে পড়ল।
(৩)
মেয়েটির প্রেগন্যান্সি চৌত্রিশ সপ্তাহ হয়ে
গেছে। এখনও পর্যন্ত বড় কিছু সমস্যা আসেনি। শুধু প্রেসারটা মাঝে মাঝে বেড়ে যাচ্ছে।
তারা প্রতি দু’ সপ্তাহ অন্তর ডাক্তারের কাছে চেক-আপ করাতে যাচ্ছে। ম্যাডাম
বলছেন কোনোভাবে আরও দুটো সপ্তাহ যদি টেনে দেওয়া যায়— উনি তারই চেষ্টা করছেন। যেহেতু টুইন বেবি, উনি ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
বাচ্চাদের ওজন তেমন বাড়েনি। বাকি দু’ সপ্তাহ তাই উনি দেখতে
চাইছেন।
ছেলেটি বাড়িতে একটা ডপলার কিনে নিয়েছে।
নিজেই দিনে তিনবার করে বাচ্চাদের হার্ট রেট চেক করে। বাড়িতে ওয়েট মেশিনে দিনে
একবার করে বউয়ের ওজন চেক করে। খাতায় লিখে রাখে। হিসেব করে নুন যাতে রান্নায় কম হয়। রান্নার দিদির কানে পইপই করে সে কথা প্রতিদিন অন্তত বার দশেক
বলবে। মেয়েটির মনে হয় এবার যেন তার স্বামী হঠাৎ করেই তার প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশি
অবসেশিভ হয়ে পড়েছে।
রাতে যখন দু’জনে একসঙ্গে শুয়ে থাকে পাশে শুয়ে ছেলেটির চোখে ঘুম আসে না। মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লে সে তার
বিরাট পেটের দিকে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পেটে হালকা করে হাত রাখে।
মেয়েটির ঘুম যাতে না ভাঙে। হঠাৎ বাচ্চাটার লাথি এসে হাতে লাগে। কিচ্ছুক্ষণ পরেই আর-একটা লাথি। মনে মনে হেসে ওঠে। দু’জনের ফুটবল খেলা চলছে।
ফুটবলের কথা মনে আসতেই তার মনে হল আচ্ছা
ছেলে না মেয়ে কী হবে? যদিও কোনোটাতেই কিছু যায় আসে না। আর এখন তো ছেলেমেয়েরা দু’জনেই ফুটবল খেলে। মেয়েদের বিশ্বকাপ ফুটবলও হয়ে গেল ক’দিন আগেই। লাথি কি শুধু ফুটবলেই? ঘোড়াও তো শুনেছে পেছনের পায়ে প্রচণ্ড লাথি দেয়। ঘোড়ার লাথিতে কত লোকের মৃত্যুর ইতিহাস আছে।
এই মৃত্যুর কথাটা মনে আসতেই তার মাথা জ্বালা
করতে শুরু করল। গলা শুকিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে জলের বোতল নিয়ে কিছুটা জল খেয়েও তৃষ্ণা
যেন মিটল না। একটা সিগারেট না খেলে টেনশন কিছুতেই কমাতে পারবে না। খুব আস্তে আস্তে
বিছানা থেকে নেমে সে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।
রাত দুটো কি আড়াইটা হবে। তাদের কমপ্লেক্সের
বাইরে আলোর এত দূষণ যে রাতের মজাটাই আসে না। তবু রাতের একটা নিজস্ব আমেজ আছে। সে
যেহেতু নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত তাই ভোরের থেকে গভীর রাত তার অনেক বেশি পছন্দের।
বর্ষা কলকাতায় ঢুকে গেছে। মাঝে মাঝে ভ্যাপসা গরমের মধ্যে একটা ঠান্ডা হাওয়া হঠাৎ
করে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।
কোভিডের ভয়ে ঘরে এসি চালানোও বন্ধ করে
দিয়েছে। এখন গলা ব্যথা হলেও ভয় লাগে। কখন কী হয়ে যায়? আগে থেকেই বেশি টাকা দিয়ে
নেওটিয়ায় সে বউয়ের জন্য একটা টুইন শেয়ারিং বেড বুক করে রেখেছে। একটা কুকুর এত জোরে
জোরে ডাকছে যে মেয়েটির ঘুম ভেঙে যাবে বলে সে দরজাটা
একটু আবজে দিল। কিন্তু সেই মৃত্যুর কথাটা তার মনে যে একবার ঢুকেছে কিছুতেই বের
করতে পারছে না। দুটো সিগারেট এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।
একটা মৃত্যুই আর-একটা জন্মের কারণ হয়ে ওঠে। একটা স্যাক্রিফাইস আর-একটা জীবনের
সৃষ্টি করে। এ নিয়ে তার কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু সেই মৃত্যুটি কার? কার মৃত্যুর
ইঙ্গিত বয়ে এনেছে ঘোড়াটা? তার নিজের? তবে ঘোড়াটা কে? সে কি? আজ গাড়ি চালিয়ে অফিস
থেকে ফেরার সময় এই কথাটা এতবার মনে আসছিল যে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে প্রায়
সামনের ডিভাইডারে মেরেই দিচ্ছিল। কোনো মতে বড় অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে রক্ষা
পেয়েছে। বউকে এসব কথা কিছু বলেনি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে এই চিন্তাটা সে কিছুতেই
মন থেকে সরাতে পারছে না।
অন্য কারও মৃত্যু দিয়ে কি
আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনা আটকানো যায়? তাদের দু’জনকে তো বেঁচে
থাকতেই হবে। যারা আসছে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকা অত্যন্ত
জরুরি। তবে সে কী করবে? যা করার তাকে একাই করতে হবে। বউকে এই নিয়ে বিব্রত করা চলবে
না। এদিকে সময় প্রায় চলে এসেছে। যে কোনোদিন ও লেবারে চলে যেতে পারে কিংবা ম্যাডাম
সিজার করে দিতে পারেন।
আচ্ছা আমাদের বাচ্চাদের জন্য আমরা তো কিছু
মানত করতে পারি?
মানত? কেন?
না মানে, আমাদের আগের দুটো বাচ্চা এভাবে
নষ্ট হয়ে গেছে।
আগের বার তো অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এবার
তো চৌত্রিশ সপ্তাহ পার হয়ে গেল। ম্যাডাম তো বলেছেন চাইলে এখনই সিজার
করা যায়।
চাইলে যায়। কিন্তু উনি তো এখনও চাইছেন না।
তাছাড়া আমি কিছুর মানত করলে তোমার তো কোনো অসুবিধে নেই।
তা নেই। তবে কীসের মানত করবে?
তুমি তো জানো এসবে আমার বিশ্বাস কম।
ধরো কালীমন্দির-টন্দিরে
একটা পাঁঠাবলির জন্য মানত তো করতেই পারি?
পাঁঠাবলি? ছিঃ, এই তুমি আজকের দিনের
আধুনিকমনস্ক মানুষ বলে নিজে গর্ব কর? একদম না। আমার সন্তান হোক না হোক, সন্তানদের
জন্য জীবহত্যা আমি একদম পছন্দ করছি না। তোমার পাগলামি তোমার কাছে রাখো। আমি আজই
ম্যাডামকে ফোন করছি আমার সিজার করে দিতে।
এই না, দাঁড়াও। বেশ ঠিক আছে। আমি বলির কথা
বাদ দিলাম। তবে তোমাকে একটা কথা বলে রাখি এর ফল কিন্তু আমাদের ভোগ করতে হবে।
তুমি কোন ফলের কথা বলছ? আমি কিছু বুঝতে
পারছি না। কয়েক মাস ধরেই দেখছি তোমার মতিগতি ঠিক নেই। রাতে ভালোভাবে ঘুমাও না।
সিগারেট খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছ। কী হয়েছে বলো তো তোমার? কী ভোগ করতে হবে? বলো?
না থাক কিছু না। তুমি এই নিয়ে চিন্তা কোরো
না। জানোই তো আমি একটু অকাল্টে বিশ্বাস করি। যাই হোক। আই অ্যাম সরি।
কথাটা শেষ হল না। বিশ্বাস করা এক জিনিস আর
অন্ধভাবে বিশ্বাস করা আর-এক জিনিস। প্লিজ তুমি এই
সময় আমার মাথাটা আর খারাপ কোরো না। আমার মন বলছে এবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এই তো
আর দু’ সপ্তাহ। তুমি দেখো এবার কিচ্ছু হবে না।
মেয়েটি ছেলেটির কাছে ঘেঁসে দাঁড়ায়। ছেলেটি
মুখে হালকা হাসি আনার চেষ্টা করে।
(৪)
সেদিন অফিসে খুব দরকারি মিটিং ছিল। বেলা দুটোর সময় কাজের
মাসি ফোন করল। বউদির জল ভেঙে গেছে। ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। অফিসে বসের সঙ্গে কথা বলে সে প্রথমেই হাসপাতালে ফোন করল। তারপর ম্যাডামকে। হাসপাতালকে জানাল
তক্ষুনি বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। সে নিজে যখন গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে
পৌঁছালো ততক্ষণে ম্যাডামও এসে পড়েছেন।
ম্যাডাম দেখার পরেই ওকে ওটিতে নিয়ে গেলেন। বাইরে বসে থেকে
ছেলেটির মাথায় নানান উল্টোপাল্টা চিন্তা ভিড় করতে শুরু করেছে। একটা মুহূর্তের
জন্যও স্থির হয়ে বসতে পারছিল না। সমানে ওটির পাশের করিডরে পায়চারি করছিল।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদে ম্যাডাম ওটির পোশাক পরেই বাইরে বেরিয়ে এলেন। মাস্ক খুললেন। ওঁর মুখটা বেশ
গম্ভীর। ছেলেটির ধুকপুকুনি আরও বেড়ে গেল। ম্যাডাম সরাসরি তার মুখের দিকে তাকালেন।
ম্যাডাম...
সরি। আপনাদের টুইনের একজনকে বাঁচাতে পারলাম
না। জন্মের পর বেবি কিছুতেই কাঁদল না। আমাদের নিওনেটলজিস্ট অনেক চেষ্টা করলেন।
কোনোভাবে আগেই ও মায়ের পেটের জল অনেকটা খেয়ে ফেলেছিল। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি
ওকে নিয়েই এতদিন চিন্তা করছিলাম। ওর ওজনটা কম ছিল। ওর জন্যই এতটা দেরি করলাম। আমার
নিজের খুব খারাপ লাগছে।
অন্য বাচ্চাটা কেমন আছে ম্যাডাম? আমার
ওয়াইফ?
দু’জনেই ভালো। আপনার মেয়ের
ওজন দু’ কেজি সাতশো। একদম সুস্থ। ওকে নিয়ে কোনো
চিন্তাই নেই। আমরা ওকে মায়ের কাছেও দিয়ে দেব কিছুক্ষণ পরে। তবে একটা কথা না বলে
পারছি না, আপনার বড় মেয়েটি যেমন কাঁদলই না ছোট মেয়েটি জন্মের পরেই এমন ভাবে কাঁদল
যে আমরা ওটির সবাই অবাক হয়ে গেছি। উই ওয়্যার জাস্ট স্টার্টলড! অ্যাট বার্থ এমনভাবে
কাঁদতে আমি আজ পর্যন্ত কাউকে দেখিনি।
এমন ভাবে বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন
ম্যাডাম?
মানে কান্নাটা খুব আনিউস্যুয়াল। আই মিন, আই
কান্ট এক্সপ্লেইন।
ঘোড়ার মতো চিঁহিঁ করে কি কেঁদে উঠেছিল?
একজ্যাক্টলি! একদম ঠিক বলেছেন! শি জাস্ট নেড। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কী করে জানলেন? আপনার তো জানার কথা না।
না মানে এই আর কি। হঠাৎ করে মনে হল।
No comments:
Post a Comment