বাক্‌ ১৫০ ।। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু ।। রাহুল দাশগুপ্ত

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মঙ্গলবার

But life is not a series of deeds. My life is my thoughts.

Gustave Flaubert

 

 

স্টেট লাইব্রেরির ঠিক পিছনেই সমুদ্র। ওরা স্টেট লাইব্রেরির ঠিক সামনে অফিসের গাড়ি থেকে নামল। লাইব্রেরির সামনে দিয়ে সোজা পিচের রাস্তা চলে গেছে। একদম সমুদ্রে গিয়ে শেষ হচ্ছে ওই রাস্তা। সমুদ্র ধনুকের মতো বেঁকে গেছে সেখানে। রাস্তার যেদিকে স্টেট লাইব্রেরি, তার অন্যদিকে বড় বড় গাছ। সেই গাছগুলোর পিছনে সবুজ জঙ্গলে ঢাকা উঁচু পাহাড়। হৃদয়পুরের এই জায়গাটাই সবচেয়ে সুন্দর।

গাড়ি থেকে নেমে দময়ন্তী চেরাবের দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল চেরাব। কী সুন্দর করেই না হাসতে পারে দময়ন্তী! আর ওর চোখ দুটোও কী সুন্দর! কী অর্থপূর্ণ সেই চোখের ভাষা! ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিলসেই বৃষ্টির মধ্যে সাদা সালোয়ার-কামিজ পরা দময়ন্তীকে রূপকথার চরিত্র বলে মনে হচ্ছে। ওরা দুজনে ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরির ভেতর ঢুকল। ঢোকার সময় ওরা খিলখিল করে হাসছিল।

রিসেপশনে যে মেয়েটি বসেছিল, সে ওদের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল। একটু রুক্ষভাবেই জানতে চাইল, কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?

ওরা নিজেদের কার্ড বাড়িয়ে দিল। মেয়েটি এক নজর দেখেই কেমন তটস্থ হয়ে গেল। জানতে চাইল, ডেথ মাস্ক? ভেজাল কোম্পানি?

ওরা মাথা নাড়ল। মেয়েটি বেশ সম্ভ্রমের স্বরে বলল, কিছু মনে করবেন না। সারাদিন এত আজেবাজে কোম্পানির লোকজন এসে ভিড় করে যে, আমরা বিরক্ত হয়ে যাই। সত্যি, এদের নাম শুনিনি কোনওদিনও, হঠাৎ হঠাৎ এসে কার্ড বাড়িয়ে দেয় আর নানারকম সুবিধা চায়। এরাই বেশি ভিড় করে। আপনাদের মতো নামকরা কোম্পানি আর ক-টা আসে? আমাদের সময় যায় বাজে লোকের পিছনে খাটতে খাটতে। অথচ আপনাদের মতো কেউ এলে, কত ভাল লাগে! আপনারা এলে, আমাদেরও লাভ হয়। স্টেট লাইব্রেরির নামটা ছড়ায়। লোকে তো বই পড়া ছেড়েই দিয়েছে। আর ওরা এলে যে আমাদের কী মাথামুণ্ডু হয়, তা আমরা নিজেই বুঝি না! তবু ওদের পিছনে সময় দিতে হয়। এতে শুধু বিরক্তিই বাড়ে...

মেয়েটি চেরাবের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিল। চোখে চোখ রেখে। দময়ন্তীর দিকে একবারও তাকাচ্ছিল না। মেয়েটি বেশ সেজেগুজে আছে। দেখতেও ভাল। চেরাব এসব সাজের কিছু বোঝে না। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে ওর বেশ ভাল লাগছিল। মেয়েটিও সেটা বুঝতে পারছিল।

মেয়েটি এবার জানতে চাইল, কেন এসেছেন আপনারা?

চেরাব বলল, রুদ্রাক্ষ সান্যাল কী এসেছেন? ওঁর সঙ্গে আমাদের একটু দরকার আছে...

রুদ্রাক্ষ সান্যাল? ভ্রূ কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড ভাবল মেয়েটি। তারপর বলল, বোধহয় না। আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।

মেয়েটি উঠে দাঁড়াল এবার। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আসুন, আপনারা...

ওরা লাইব্রেরির বিশাল রিডিংরুমে পৌঁছল। অনেকেই বসে বই পড়ছে। পাশ দিয়ে লম্বা, টানা বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়।

মেয়েটি বলল, আপনারা এখানে বসতে পারেন। অথবা ওই বারান্দায় গিয়ে...

একবার বারান্দায় চলুন...

ওরা বারান্দায় এল। এখানে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই অল্পবয়সী যুবক। যারা একা, তারা রেলিংয়ে হেলান দিয়ে সমুদ্র দেখছে। দুজন থাকলে, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। মেয়েটি ভ্রূ কুঁচকে ওদের দিকে তাকাল। তারপর চেরাবের কানের কাছে নিজের ঠোঁট নিয়ে এসে আলতো করে ছোঁয়াল। ফিসফিস করে বলল, এই যে, এরাই সেই উপদ্রব। সকাল থকে এসে বসে আছে। কেউ কোনওদিন এদের কোম্পানির নাম শোনেনি। আমি তো বাপের জন্মে শুনিনি। কোত্থেকে যে এসে হাজির হয়! তারপর আবার কোথায় যে উধাও হয়ে যায়!

এরা কেন আসে? চেরাব জানতে চাইল।

দরকার কী একটা? মেয়েটি হাসল। চেরাবের কানের কাছ থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিল। চেরাব কিন্তু তখন দেখছিল সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে। যুবকটি একাগ্র হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ম্লান হয়ে গেছে মুখটা। হঠাৎ আঘাত পেলে যেমন হয়। এই যুবকটি কী মেয়েটির কথা শুনেছে? নিশ্চয়ই যুবকটি এমন কোনও কোম্পানি থেকে এসেছে, যার নাম মেয়েটি আগে কখনও শোনেনি। যাদের সম্পর্কে মেয়েটির মনে তীব্র বিতৃষ্ণা।

চেরাবের হঠাৎ মনে হল, ওই যুবকটির জায়গায় সে-ও তো ওখানে থাকত পারত! মেয়েটি কী তখন ওর ব্যাপারে এত আগ্রহ দেখাত? না, বোধহয়। ওই যুবকটিকে যেভাবে তাচ্ছিল্য করছে, ওকেও বোধহয় ঠিক সেভাবেই তাচ্ছিল্য করত।

মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল। চেরাব হঠাৎ লক্ষ্য করল। মেয়েটির বুকের ভাঁজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আর সে তা জানেও। স্তনের যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা মাখনের মতোই নরম। পরিতোষ সেন যেমন লিখেছেন, ‘নগ্ন নির্জন নারী তুমি‘তে। দময়ন্তীও কী লক্ষ্য করেছে? চেরাব তাকিয়ে দেখল। দময়ন্তী একদৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ দময়ন্তী ফিরে তাকাল। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, বইয়ের র‍্যাকগুলো একটু দেখা যায়?

ওখানে ঢোকার জন্য বিশেষ অনুমতি লাগে। মেয়েটি বলল। একটু রুক্ষ স্বরেই। তারপর আবার চেরাবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি স্বরে হেসে বলল, কিন্তু আপনাদের লাগবে না।

কেন? চেরাব অবাক হয়ে জানতে চাইল।

কারণ, মেয়েটি চেরাবের চোখে চোখ রেখে বলল, আপনারা ‘ডেথ মাস্ক" থেকে এসেছেন। আপনাদের জন্য আমাদের আলাদা ব্যবস্থা

চেরাব খুশি হল। ঠিক সেই সময় ওই যুবকটি এগিয়ে এল। চেরাব লক্ষ্য করল, দময়ন্তী ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের একবার চোখাচোখিও হল। কিন্তু যুবকটি চোখ সরিয়ে রুক্ষ স্বরে প্রবল বিরক্তি নিয়ে বলল, এটা কী আপনাদের ঠিক হচ্ছে? আমি সাতদিন ধরে ঘুরছি, আপনারা আমাকে ধারেকাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। আর ওনারা, আজই প্রথম দেখছি, অথচ আপনি ওদের...

বেশি কথা বলবেন না মশাই, মেয়েটি ধমকে উঠল, বুঝেছেন? কোন কোম্পানি থেকে এসেছেন আপনি? অ্যাঁ? কেউ চেনে আপনার কোম্পানিকে? কেউ শুনেছে তার নাম? আর ওরা এসেছেন...

ডেথ মাস্ক থেকে! যুবকটি একবার সম্ভ্রমের চোখে ওদের দিকে তাকায়। তারপর সরে যায় সেখান থেকে।

মেয়েটি একটু এগিয়ে যায়। দময়ন্তী একটু নিচু স্বরে বলে, বাইরে আমাদের কোম্পানির কী সম্মান!

চেরাব বিরক্তি নিয়ে বলে, আর ভেতরের কী চেহারা! কী অপমানিতই না হতে হয় কর্মীদের! কেউ জানে সে কথা? স্পর্শকে আজ কান ধরে ওঠবোস করাতে চেয়েছে অজিতেশ। কী কদর্য!

মৃদু হাসে দময়ন্তী। তারপর বলে, ভেতরটা আর ক-জন দেখতে পায় বলো? সবাই তো শুধু বাইরেটাই দ্যাখে। কিন্তু, ওই মেয়েটার ব্যাপারটা কী? হ্যাঁ? কিছু বুঝতে পারছ?

চেরাব চমকে ওঠে। সবই লক্ষ্য করেছে দময়ন্তী।

 

পর পর সমান্তরাল সারিতে একের পর এক উঁচু উঁচু বইয়ের র‍্যাক। দুটো র‍্যাকের মাঝখানে সরু চলার পথ। জায়গাটায় আলো ঠিকমতো ঢোকে না। আবছামতো। সেখানেই চেরাব আর দময়ন্তী, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল।

দময়ন্তীই কথা বলল, তুমি কিন্তু আমার কথার উত্তর দাওনি।

কোন কথা? চেরাব জানতে চায়।

আরে, ওই মেয়েটা...

এ্রখানে নিয়ে এলে কেন? হঠাৎ বলে উঠল চেরাব।

দময়ন্তীর মুখে একটু দুষ্টুমির হাসি। বলল, আমি নিয়ে এসেছি?

নিশ্চয়ই। তুমিই।

দময়ন্তী বলল, এই জায়গাটা আমার ভাল লাগছে না। চলো, জানালার ধারে যাই।

কাঁচের জানলা। ভেতর থেকে বাইরেটা দেখা যায়। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায় না। জানলার বিপরীতদিকে উঁচু র‍্যাক।

চেরাব দময়ন্তীর দিকে তাকাল। অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। আর তেমনই অস্থির লাগছে। জীবনে এরকম পরিস্থিতি আগে কখনও আসেনি। দময়ন্তীকে কিন্তু শান্তই দেখাচ্ছে।

তাকে যত দেখছি ততই বারবার তামিলনাড়ুর বিখ্যাত নাগেশ্বরম মন্দিরের গায়ে খোদিত দণ্ডায়মান অর্ধনগ্না রাজকুমারীর মূর্তিটির কথা মনে আসছে। যে মূর্তিটি নবম শতকের প্রখ্যাত চোলা শৈলীর এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন হয়ে ভারতীয় ধ্রুপদি ভাস্কর্যের বহু বইয়ে স্থান পেয়েছে। পরিতোষ সেন। নগ্ন নির্জন নারী তুমি। চেরাবের মনে পড়ল।

ভেতরের উত্তেজনাকে চেপে শান্তভাবে সে বলল, আমার বুকে এসো। সে নিজের দু-হাত ছড়িয়ে দিল। আর সেই মুহূর্তেই দময়ন্তী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকে।

চেরাব ওর সারা মুখে চুমু খেতে লাগল। একের পর এক চুমু। কোথাও বাদ দিল ন। বিশেষ করে ওর ঠোঁটদুটো নিয়ে অনেকক্ষণ চুষল। তারপর হঠাৎ হাত দিয়ে ওর বুকদুটো টিপতে লাগল। প্রথমে বাঁদিকেরটা, তারপর ডানদিকেরটা। দময়ন্তী কোনও বাধা দিচ্ছে না। বরং যেন চাইছে আরও বেশি করে। এতে চেরাবের সাহস আর উৎসাহও আরও বেড়ে গেল।

চেরাব দময়ন্তীর দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমার আরও চাই।

দময়ন্তী বলল, আরও? আর কী চাও তুমি?

চেরাব বলল, তোমাকে দেখতে চাই। এই পোশাকগুলো, দূর, এগুলোর কোনও মানেই হয় না! সে দময়ন্তীর গেঞ্জিটা খুলতে শুরু করল। দময়ন্তী এখন শুধু ব্রা পরে আছে। একটা লাল ব্রা। চেরাবের উত্তেজনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোনও মেয়েকে আজ পর্যন্ত এই অবস্থায় সে দেখেনি। শুধু ব্রা পরা অবস্থায় মেয়েদর বুক দুটো কী অসম্ভব সুন্দর লাগে। চেরাব দময়ন্তীর ব্রা-টাও এবার খুলে ফেলল।

সে তাকিয়ে রইল দময়ন্তীর বুক দুটোর দিকে। কী অসম্ভব সুন্দর দুটো বুক. গোলাপি, মসৃণ, নিটোল। আর স্তনের বোঁটা শক্ত হয়ে গেছে। তার চারপাশে গোল হয়ে ছড়িয়ে আছে অনেকটা খয়েরি অংশ। চেরাব বেশ কিছুক্ষণ দময়ন্তীর বুকের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ দিল সেখানে। চুষতে লাগল। আগে কখনও তার এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি। বাস্তবিকই এ এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা তার কাছে। সে অনেকক্ষণ ধরে একটা বুক চুষল। তারপর অন্য বুকটা। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।

Nothing like a suck of the breast. Donald Barthelme.

 

হঠাৎ দময়ন্তী বলে উঠল, এই লোকটিই কি রুদ্রাক্ষ সান্যাল?

চেরাব দময়ন্তীর দুটো বুকের ভাঁজে মুখ রাখল। খুব সুন্দর জায়গা এটা। একটা উপত্যকার মতো। দু-দিকের দুটো উঁচু পাহাড় উঠে গেছে। কী নরম আর কোমল সেই পাহাড় দুটো। তাদের মাঝখানে অন্ধকার একটা জায়গা। যেন একটা সংকীর্ণ গিরিখাত। পুরুষের একান্ত নিজস্ব ও নিভৃত একটা জায়গা। সব পুরুষই এই জায়গায় কখনও না কখনও আশ্রয় নিতে চায়আশ্রয় পেতে ভালবাসে। চেরাব জোরে জোরে শ্বাস নিতে চাইছিল। অদ্ভুত একটা গন্ধ থাকে মেয়েদের বুকের ভাঁজে। এটা কি ঘামের গন্ধ? চেরাবের কোনও ফুলের গন্ধ বলেই মনে হচ্ছিল।

দময়ন্তী আবার বলে ওঠে, আমার মনে হয়, রুদ্রাক্ষ সান্যাল লাইব্রেরির দিকে আসছেন...

চেরাব এবার মাথা তোলে। তারপর বলে, তুমি কেমন মানুষ? এই অবস্থায়ও তোমার কাজের কথা মনে পড়ে?

দময়ন্তী চেরাবের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, আমরা তো কাজ করতেই এসেছি, তাই না? অফিসের কাজ?

চেরাব এবার খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর জানলার দিকে তাকায়। একজন অতি বৃদ্ধ ধীরে ধীরে সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছেন। কাছেই তাঁর বাড়ি হবে। তিনি ঘুরে যাবেন এবার। তারপর লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হেঁটে এসে মূল গেট দিয়ে ঢুকবেন। মকবুলের বর্ণনা মনে পড়ল চেরাবের। দময়ন্তীকে সে বৃদ্ধের বর্ণনা দিয়েছিল। একটু পরেই বৃদ্ধ রিডিংরুমে ঢুকবেন। হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু এই অবস্থায়, দময়ন্তীকে ছেড়ে, সে কোথায় যাবে? চেরাব বলে ওঠে, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার বুক দুটো আমার খুব ভাল লাগছে। আমি এখন কোথাও যাব না!

সে আবার দময়ন্তীর বুকে মুখ রাখতে যায়। কিন্তু দময়ন্তী সরে যায়। তারপর নিচু হয়ে নিজের ব্রা তুলে নিয়ে পরতে থাকে। চেরাব সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সে যেন চোখ ফেরাতে পারছে না. শুধু ব্রা পরেও দময়ন্তী খুব সুন্দর। এবার দময়ন্তী গেঞ্জিও পরে নেয়। চেরাব দময়ন্তীর বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। উঁচু হয়ে আছে দুটো বুক। সেই বুকের থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না। একটু আগেও, কয়েক সেকেন্ড আগেও, ওই বুক দুটো ছিল শুধু ওর নিজের। একটু আগেও যা ঘটছিল, তা ছিল নিছকই ওদের একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এখন আবার ওকে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিতে হবে। দময়ন্তীও আর ওর নিজের থাকবে না। অফিসের কলিগ হয়ে যাবে।

চেরাব জানতে চাইল, আর একটু থাকা যেত না? তার গলার স্বর কাতর শোনায়।

দময়ন্তী মৃদু হাসে। তারপর বলে, যেত। কিন্তু তাতে তোমার লাভ আরও বেড়ে যেত। তুমি বড় বেশি আবেগপ্রবণ। আমি তা নই। তাছাড়া, আমরা একটা কাজে এসেছি। তাই না?

তোমার ভাল লাগেনি?

দময়ন্তী আবার চেরাবকে কাছে টেনে নেয়। তারপর ওর ঠোঁট দুটো চুষতে থাকে। একটু পরে নিজের মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে, হয়েছে?

কী হবে? চেরাব বলে। তার গলাটা শুনে মনে হয়, কোনও শিশু যেন আবদার করছে।

ভাল লেগেছে? দময়ন্তী আবার জানতে চায়।

খুব।

হঠাৎ চেরাবের একটা কথা মনে হয়। সে বলে, আমি তোমার ভেতর ডুবে ছিলাম। তুমি তখন জানলার দিকে তাকিয়ে ছিলে কেন?

দময়ন্তী একটু থমকে যায়। তারপর বলে, ওই ছেলেটাকে হঠাৎ দেখতে পেলাম। ওই যে ছেলেটা, বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। ওকে দেখতে একদম অগ্নিমিত্রের মতো, তাই না?

চেরাবের মনে হয়, হঠাৎ কেউ যেন তাকে ছুরি মেরেছে। কিছুক্ষণের জন্য সে থমকে যায়। কোনও কথা বলতে পারে না। সে জানলা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকায়। আর ঠিক তখনই সে কালো ঘোড়াটাকে দেখতে পায়।

 

মকবুলের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে চেরাব। রুদ্রাক্ষ সান্যাল লোকটিকে চেনা যায়। সে লোকটির সামনে গিয়ে বসে। নিজের ও দময়ন্তীর পরিচয় দেয়। একটু পরেই আলাপ জমে ওঠে ওদের। বাইরে তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।

রুদ্রাক্ষ বলছিলেন, পুঁথিটা আমার বাড়িতে রয়েছে। আমার সঙ্গে তোমাদের যেতে হবে।

ঠিক সেই সময় সেই ছেলেটি এসে হাজির হল ওদের সামনে। তারপর বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। আমি সাতদিন ধরে ঘুরছি। আমাকে একটু সময় দেবেন?

রুদ্রাক্ষ একটু বিরক্তই হলেন। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কী ব্যাপার?

আপনা কাছে একটা পুঁথি আছে স্যার। তাই না? কাগজে বেরিয়েছিল?

হ্যাঁ

ওই পুঁথিটা আমাদের কোম্পানি চায়। সেইজন্যই আমি এসেছি।

কী নাম তোমাদের কোম্পানির? রুদ্রাক্ষ জানতে চান।

ছেলেটি নাম বলে। রুদ্রাক্ষ মার্জিত স্বরে বলেন, আমাকে মাফ করতে হবে ভাই। আমি তোমাদের কোম্পানির নাম শুনিনি। গত কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আমার কাছে লোক আসছে। ব্যাঙের ছাতার মতো এদেশে ভেজাল কোম্পানি গড়ে উঠেছে। সবারই এই পুঁথিটা দরকার। সবাই পুঁথিটি ভেজাল করতে চায়। রাষ্ট্রের নাকি এই পুঁথিটি খুব কাজে আসবে। কিন্তু আমি তো সবাইকে এই একটি পুঁথি দিতে পারব না। এরা দুজন এসেছেন "ডেথ মাস্ক" কোম্পানি থেকে। এ দেশে সবাই এই কোম্পানিকে চেনে। আমি ঠিক করেছি, পুঁথিটি এদেরই দেব।

ছেলেটির চোখেমুখে তীব্র হতাশা ফুটে ওঠে। তারপর বলে, ঠিক আছে। সত্যিই আপনার কিছু করার নেই। সাতদিন ধরে ঘুরছি। একবার একটু বইয়ের র‍্যাকগুলো দেখতে চাইলাম। সেটুকু পর্যন্ত এরা দিল না। আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। পেটের দায়ে চাকরি করতে ঢুকেছি। পড়াশুনো ভালবাসি। কিন্তু এরা তো শুধু বোঝে কোম্পানির নাম!

ছেলেটি চলে যায়। দময়ন্তী সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

একটু পরে বৃদ্ধর সঙ্গে চেরাব আর দময়ন্তী বেরিয়ে আসে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ওদের দেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর চেরাবের দিকে তাকিয়ে বলে, কাজ হয়েছে?

একটু বাকি। চেরাব বলে।

মেয়েটি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, আবার আসবেন। আপনাদের মতো কোম্পানি...

বৃদ্ধ তখন কিছুটা এগিয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে দময়ন্তী। চেরাব আর দাঁড়ায় না। বৃদ্ধর বাড়ি কাছেই। সমুদ্রের ধার দিয়ে ওরা বেশ কিছুটা হেঁটে যায়। বৃষ্টি থেমে গেছে। সমুদ্রের ধারেই বৃদ্ধের বাংলো-টাইপ দোতলা ছিমছাম বাড়ি। ওরা সেই বাড়িতে ঢোকে।

রুদ্রাক্ষ দোতলায় নিজের স্টাডি-রুমে ওদের নিয়ে যান। তারপর বলেন, সামান্য একটু অসুবিধা আছে। আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।

আমাকে বলুন না। চেরাব বলে।

আসলে পুঁথিটি রয়েছে সবচেয়ে ওপরের তাকে। তুমি এই স্টিলের সিঁড়িটা দিয়ে উঠে যাও। পুঁথিটা খুঁজে নিয়ে এসো। আমাকে যে ছেলেটি অ্যাসিস্ট করে সে আসবে সন্ধের পরে।

চেরাব স্টিলের সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে যায়। দময়ন্তী চারদিকে তাকিয়ে দেখে। শুধু বই আর বই। এবার সে জানতে চায়, আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই?

নাঃ! আমি একাই থাকিথাকবার মধ্যে তো আছে আমার মেয়ে আর জামাই। আমার স্ত্রী বহুদিন আগেই মারা গেছেন। তা, ওরা দুজনও তো সবসময় আসতে পারে না। কাজে খুব ব্যস্ত থাকে।

চেরাব নেমে আসে। হাতে সেই অমূল্য পুঁথি। সারা মুখ ঝলমল করছে। সে বলে, একবার আমাদের অফিসে যেতা পারবেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বৃদ্ধ বলেন। কিন্তু তখনও তোমার একটা কাজ বাকি আছে।

চেরাব অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকায়।

 

বৃদ্ধ বলেন, আমার বন্ধু আনসার আলি অসম্ভব ভাল সংস্কৃত জানতেন। এই লাইব্রেরিতে আসার ঠিক আগেই খবর পেলাম তিনি মারা গেছেন।

আনসার আলি মারা গেছেন? চমকে উঠে জানতে চায় চেরাব। সংস্কৃত পণ্ডিত হিসাবে আনসার আলির নাম কে না জানে! দময়ন্তীর মুখে অবশ্য কোনও ভাবান্তর দেখা যায় না।

হ্যাঁ। আমি অবশ্য যাইনি। ওরকম জীবন্ত একজন মানুষ! সেই স্মৃতিগুলিই থাক। ওকে এইভাবে দেখা, আমি পারতাম না। আমি আমার রোজকার রুটিন বদলাইনি। লাইব্রেরিতে চলে গেছিলাম।

চেরাব চুপ করে শোনে। বৃদ্ধ এখনও আসল কথাটাই বলেননি। রুদ্রাক্ষ বলে চলেন, তোমাকে যে পুঁথিটি দিয়েছি, তার কিছুটা অংশ সংস্কৃত ভাষায় লেখা। আনসার সেটা অনুবাদ করবে বলে আগ্রহ দেখায়। আমিও ওকে দিয়ে দিই। গতকাল রাতেই আনসার আমাকে ফোনে জানায়, কাজটা হয়ে গেছে, কিন্তু সে একবার আমার সঙ্গে বসতে চায়। তার কিছু বলার আছে। পুঁথিটায় এমন চমকপ্রদ কিছু আছে, যেটা ওকে অসম্ভব উত্তেজিত করে তুলেছে। তাই বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে ও আলোচনা করতে চায়... তুমি এক্ষুণি কবরখানায় চলে যাও।

ওখানেই কী আমি শীলভদ্রকে পাব? চেরাব হঠাৎ জানতে চায়।

তুমি শীলভদ্রের নাম জানো? অবাক হয়ে পালটা জানতে চান রুদ্রাক্ষ।

চেরাব লাজুকের মতো হাসে। তারপর বলে, জানব না? আনসার আলির সেক্রেটারি। আনসার আলিকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন...

আনসার আলিকে কবর দেওয়া হচ্ছে এখন। ওখানেই তুমি শীলভদ্রকে পাবে।

চেরাব জানতে চায়, পুঁথিটা এখন কোথায়?

সেটা একমাত্র শীলভদ্রই জানে। ওই জন্যই তোমায় বলছি আর দেরি না করে...

আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। চেরাব উঠে দাঁড়ায়।

তুমি শীলভদ্রকে চিনবে কী করে? হঠাৎ রুদ্রাক্ষ জানতে চান।

শীলভদ্রকে আমি আনসার আলির সঙ্গেই দেখেছি। ছবিতে। তাছাড়া শীলভদ্রের লেখার সঙ্গেও আমি পরিচিত।

বৃদ্ধ খুবই মুগ্ধ হয়ে বললেন, তুমি একজন বিরল মানুষ! আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েরা তো খেলা আর সিনেমার লোকজন ছাড়া আর কাউকেই চেনে না! নিজের দেশটাকে, সেই দেশের গুণী মানুষগুলোকে না চিনলেও তাদের দিব্যি চলে যায়!

চেরাব আর অপেক্ষা করে না। দময়ন্তী একবার শুধু বলে, আমি কী করব?

তুমি এখানেই থাকো।

চেরাব বেরিয়ে যায়। বাইরে আবার অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে দময়ন্তীকে নিয়ে সে কোথায় যাবে? রুদ্রাক্ষ একটা ছাতা দিয়ে দিয়েছেন। সেটা মাথায় দিয়ে চেরাব সমুদ্রের ধার দিয়ে ছুটতে থাকে। আর ঠিক তখনই তার পাশ দিয়ে ছুটে চলে যায় কালো ঘোড়াটি। চারপাশে অন্ধকার। কোথাও কিছু প্রায় দেখা যাচ্ছে না। শুধু বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, বৃষ্টিপাতের একটানা একঘেয়ে শব্দ, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের অবিরাম গর্জন মিলেমিশে কেমন একটা ত্রাসের পরিবেশ যেন সৃষ্টি করেছে। ঘোড়াটি এরই মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। এই দুর্যোগের মধ্যে কী করছে ঘোড়াটি? তাকে কী অনুসরণ করছে? কিন্তু কেন? চেরাব আর ভাবতে পারে না। কবরখানায় যখন চেরাব পৌঁছয়, তখন বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। কবরখানার গেট দিয়ে একটা ভিড় বেরিয়ে আসছে। প্রায় সবারই মাথায় ছাতা। কেউ কেউ ছাতা বন্ধ করছে। তাদের মধ্যেই শীলভদ্রকে দেখতে পায় চেরাব। ছাতা বন্ধ করে কেমন অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। শান্ত, সৌম্য মূর্তি। মুখে সাদা দাড়ি, সাদা চুল। ধুতি, পায়জামা পরে দাঁড়িয়ে আছেন। কোথায় যাবেন, কোন দিকে যাবেন ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

চেরাব সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের পরিচয় দেয়। শীলভদ্র বলেন, কোথাও গিয়ে কথা বলি চলুন। কবরখানার ভিতরটা সুন্দর। কিন্তু বাইরে এই জায়গাটায় কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। কী বিষণ্ণ এই পরিবেশ! মৃত্যুর ছায়ায় যেন ঢেকে আছে জায়গাটা। চলুন...

শীলভদ্র আর দেরি করতে চান না। তিনি দ্রুত হাঁটতে থাকেন। চেরবা তাঁকে অনুসরণ করে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। আনসারি আলি খুব বিখ্যাত লোক ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শীলভদ্র ভিড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তিনি সমুদ্রের দিকে হাঁটছিলেন। সমুদ্রের ধারে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। তারপর জানতে চাইলেন, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?

আমি আপনাকে চিনি। আপনার লেখাও পড়েছি।

চেরাবের কথায় শীলভদ্রও একটু অবাক হলেন। মুগ্ধও। তিনি বললেন, এবার বলুন...

চেরাব খুলে বলল সবকিছু। শীলভদ্র মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, আপনার কপাল ভাল। মূল পুঁথি আর আনসার আলির অনুবাদ, দুটোই আমার সঙ্গেই আছে...

তিনি নিজের কাঁধের ঝোলা থেকে সেগুলো বার করলেন। তারপর বললেন, চলুন, আমি বরং আপনার সঙ্গেই যাই...

শীলভদ্র আবার সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে থাকেন। চেরাবের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, আমি এখন একটু একা থাকতে চাই। না, ঠিক একা নয়। বরং রুদ্রাক্ষবাবুর সঙ্গে থাকাই ভাল। উনি আমার অবস্থা বুঝবেন।

শীলভদ্রকে দেখে রুদ্রাক্ষ সান্যাল সত্যিই খুব খুশি হয়ে উঠলেন। দু-হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন শীলভদ্রকে। বললেন, চলেই এলে তাহলে?

পালিয়ে এলাম বলতে পারেন। শীলভদ্র বললেন। নইলে প্রেসের লোকজন এতক্ষণে আমাকে...

তা, বেশ করেছ। রুদ্রাক্ষ বললেন, আমাকে একবার এদের অফিসে যেতে হবে যে। কিন্তু যাব কী করে?

আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। আপনাকে আবার পৌঁছে দিয়ে যাব। চেরাব বলল।

ঠিক আছে। রুদ্রাক্ষ বললেন। তুমি আজকে কামাল করে দিয়েছো ভাই! তারপর তিনি শীলভদ্রের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি বরং আমার স্টাডিরুমে একটু রেস্ট নাও। খুব ধকল গেছে তোমার। তেমন হলে, রেকর্ড প্লেয়ারটা চালিয়ে নিও। পছন্দের গান শুনো। আনসার খুব গান ভালবাসত। কিছুদিন আগে সুফি গান আর সংস্কৃত চ্যান্টিংয়ের দুটো রেকর্ড দিয়েছিল ও। আমি ফিরে আসি, তারপর কথা হবে। আনসারকে নিয়ে অনেক কথা আছে আমার, দুনিয়ায় যা শুধু তোমাকেই বলা যায়...

শীলভদ্র স্টাডিরুমে ঢুকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। সেন্টার টেবিলে রাখা আছে দুই খণ্ডে জালালুদ্দিন রুমির "মসনবি"-র ইংরেজি অনুবাদ। তার পাশেই রাখা আছে, ফরিদুদ্দিন আত্তারের "দি কনফারেন্স অফ দ্য বার্ডস"। আত্তারের বইটির নিচ থেকে উঁকি মারছে লুক্রেসিয়াসের "অন দি নেচার অফ দ্য ইউনিভার্স। আর তারও নিচে রয়েছে লুসানের "সিভিল ওয়র" (ফার্সেলিয়া)। শীলভদ্র "মসনবি"-র প্রথম খণ্ড হাতে নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে যান।

রুদ্রাক্ষ সান্যাল বলেন, শ্রীঅরবিন্দ কী বলতেন জানো? চিন্তা করার অক্ষমতা বা চিন্তা "ফোবিয়া"ই মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। চিন্তাশক্তি হ্রাস পেলে অজ্ঞানতা বেড়ে যায়, ক্ষণিকের উত্তেজনা বেড়ে যায়। আনসার প্রথম আমাকে শ্রীঅরবিন্দ পড়িয়েছিল। বলেছিল, কী বিরাট, আকাশচুম্বী প্রতিভা ছিল এই মানুষটার...

রুদ্রাক্ষ থেমে যান। বুকের মধ্যে "মসনবি"-কে জাপ্টে ধরে শীলভদ্র ঘুম লাগিয়েছেন। নাক ডাকতে শুরু করেছেন তিনি। রুদ্রাক্ষ তৈরি হতে ভেতরে চলে যান।

 

একতলায় ড্রয়িংরুমে বসে সোফায় গা এলিয়ে দেয় চেরাব। দময়ন্তী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, তোমাকে এত খুশি হতে আগে কখনও দেখিনি...

অফিসে ঢোকার পর থেকেই আমি খুব বিষণ্ণ ছিলাম। কিছুতেই যেন আনন্দ পাচ্ছিলাম না। কিছুতেই না...

কিন্তু আজ তুমি অফিসের হয়ে একটা কৃতিত্ব দেখালে বটে! কিছু করে দেখাতে পারলে মানুষ খুব খুশি হয়ে ওঠে, তাই না?

আমি খুব চাপ বোধ করছিলাম। ওরা আমাকে চেপে দিচ্ছিল। আমি ঠিক মন খুলে মিশতে পারছিলাম না। কিছু করতে পারছিলাম না।

হুঁ, তবু উৎসাহ পেলে তুমি কী করতে পারো...

বৃদ্ধের সদিচ্ছা আর তোমার সাহচর্যকে বাদ দিও না। স্টেট লাইব্রেরিতে যে দুপুরটা কাটিয়েছি, এমন দুপুর আগে কখনও আমার জীবনে আসেনি।

রুদ্রাক্ষ বেরিয়ে এলেন। আবার সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরি। লাইব্রেরির সামনে রাস্তায় অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছেদময়ন্তী বৃদ্ধকে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে, চেরাব উঠতে যাবে, ঠিক এই সময় কে যেন পিছন থেকে এসে তার কাঁধে হাত রাখল। চেরাব তাকিয়ে দেখল, সেই ছেলেটি। সে অবাক হয়ে গেল।

ছেলেটি বলল, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

চেরাব সরে এল। ছেলেটি বলল, আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দেবেন? আমি যোগাযোগ করব...

কী ব্যাপারে একটু বলবেন? ছেলেটির প্রতি কিছুটা সমবেদনাই বোধ করছিল চেরাব।

ছেলেটি একটু সংকোচ নিয়েই বলল, আসলে আমি আপনাদের কোম্পানিতে অ্যাপ্লাই করতে চাই। আপনাদের কোম্পানির খুব সুনাম। কীভাবে কী করব, আপনার কাছ থেকে জেনে নিতে চাই...

চেরাব কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। সে তো কোনও অ্যাপ্লাই করেনিএই চাকরিও সে করতে চায় না। পারলে ছেড়েই দেয়। অফিসের ভেতরের ছবিটা ভাবলেই তার নিজেকে কেমন অসুস্থ মনে হয়। আর এই ছেলেটা সেই চাকরির স্বপ্ন দেখছে? মনের মধ্যে আশার জাল বুনছে? এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে, শুধু এই সামান্য কয়েকটা কথা বলবে বলে?

দেশের ছবিটা এক মুহূর্তের জন্য যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল তার চোখে। এই দেশে কোনও রিস্ক নেওয়া যায় কী? ছেলেটা ওকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়, যেন বা অনুরণনই সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তাড়াতাড়ি ওকে নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে সে গাড়িতে উঠে বসে। ছেলেটি পেছন ঘুরে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে। দূরে দেখা যায় কালো ঘোড়াটাকে। অন্ধকার মিশে আছে। তবু চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি কমে গিয়ে আকাশে এখন ঝলমলে চাঁদ।

এই প্রথম চেরাব অফিসে ঢোকে বিজয়ীর মতো, জড়োসড়ো হয়ে নয়। রুদ্রাক্ষকে নিয়ে ওরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে। ওদের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। মনে মনে তারিফ করছে নিশ্চয়ই। মকবুল ওদের দেখেই অভ্যর্থনা জানাতে উঠে আসে। বৃদ্ধকে খাতিরযত্ন করে বসায়। বলে, ওরা তাহলে আপনাকে খুঁজে বার করেছে?

সেটা তো এমন কিছু কঠিন কাজ নয়! বৃদ্ধ হেসে বলেন।

তা ঠিক। কিন্তু কাজটা কঠিনই ছিল। বাজারের খবর আমি জানিপুঁথিটির জন্য বেশ লম্বা লাইন পড়ে গেছে।

হ্যাঁ, ওরা আমার মন জয় করেছে। অবশ্য আপনাদের কোম্পানির নামটাই যথেষ্ট ছিল...

মকবুল তারিফ করার মতো করে হাসে। রুদ্রাক্ষ আবার বলে, তবে আপনাদের ওই ছেলেটি আজ একেবারে কামাল করে দিয়েছে...

তাই নাকি? মকবুল বলে ওঠে। বেশ তো, সময় নিয়ে শোনা যাবে...

তারপর রুদ্রাক্ষকে নিয়ে যায় বসের ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়।

রুদ্রাক্ষ চলে গেলে দময়ন্তী বলে ওঠে, চেরাব আজ ফাটিয়ে দিয়েছে। কোনও উঁচু তাক থেকে খুঁজেপেতে পুঁথিটা খুঁজে এনেছে। আমার তো দেখেই ভয় করছিল। তারপর যা দুর্যোগের দিন ছিল আজ! শীলভদ্রকে ওই তো খুঁতে পেতে বার করেছে। আস্ত পুঁথিটা নইলে যে পাওয়াই যেত না...

মকবুল জোরে হেসে ওঠে। একটু পরেই চেরাব আর দময়ন্তী অফিস থেকে বেরিয়ে আসে।


No comments:

Post a Comment