বাক্‌ ১৫০ ।। রিপন হালদার


 

স্পেশ্যাল রিপোর্ট  

 

আপনি গান্ধীজীকে চেনেন তো?

চিনি মানে?

সরি! মানে ওঁর সম্পর্কে জানেন তো! বর্তমান সময়ে ওঁর সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন? এই আর কি!

তাই বলুন!... সত্যি বলব? এডিট করবেন না তো?

সিওর! সত্যিটাই তো শুনতে চাইছি! এডিটের প্রশ্নই নেই! স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ না আমাদের!

ঘটনা হল ওকে আমরা শুধু টাকার মধ্যে বন্দি করে রেখেছিদেখুন চারদিকে ঘুরে! অহিংসার কথা বলে দেখুন তো একবার! আমার এক কলিগ কী বলে জানেন?

কী বলে?

বলে ওনার জন্যই নাকি ভারতের এই অবস্থা।

কী অবস্থা?

এই যা কিছু সমস্যা... কলিগ আর বলে, “উনি বলেছিলেন না আমার দেহের উপর দিয়ে দেশভাগ হবে! হল তো আর ওনার দেহও অক্ষত রইল!” কিন্তু আমরা তো জানি পরিস্থিতি তখন ওঁর পক্ষে ছিল না। অবশ্য পরে এর জন্য তো ওঁকে জীবনও দিতে হল! একথা শুনে কলিগ রেগেমেগে বলে, “রাখুন মশাই! পরিস্থিতিকে যদি কন্ট্রোলে না-ই আনতে পারলেন তাহলে কীসের জাতির পিতা!” দুঃখের কথা হল শুধু আমার কলিগই না, আমার পরিচিত অর্ধপরিচিত সবারই মোটামুটি এই মত।

তাই! তা আপনার নিজের কী মত?

আমার মতে আর কী যায় আসে! এদের বোঝাতে পারি না। মানুষটার আত্মত্যাগ, সরল জীবনযাপন, সততা, এর সামান্যও যদি মানুষ নিজেদের জীবনে কাজে লাগাতে পারত, দেশটা আজ এমন হত না। আসল কথা হল সততা। এটা খুব ইমপরট্যান্ট জিনিস... এতে হবে, না আর বলব?

ঠিক আছে।

রাতের খবরেই দেখতে পাব তো? চলি! আমাকে এখন আবার নায়িকাকে মেকাপ করতে যেতে হবে!

মানে! ইন্টারভিউর শুরুতে যে বললেন আপনি মাস্টার?

হ্যাঁ। ঠিকই তো বলেছি! আমাকে তো ইন্ডাস্ট্রির সবাই মেকাপ-মাস্টারই বলে ডাকে!

ধুর! টাইম খারাপ করলেন! সব ডিলিট করতে হবে! যতসব ভুলভাল লোক!

আমি কী ভুল করলাম! আপনিই তো বুঝতে ভুল করলেন! কিন্তু কথাগুলো তো ঠিক বলেছি! রাখা কি যায় না?

ভেবে দেখব। যান তো এখন! মাথা গরম করবেন না! অফিস থেকে বলে দিয়েছে সন্ধ্যার মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে! বারোটা বেজে গেল। ঠিকঠাক একজনও পেলাম না! আচ্ছা, এখান থেকে এসপ্ল্যানেড কীভাবে যাব?

নিজে খুঁজে নিন!

ধুর! কিচ্ছু হবে না এই দেশের!

#

বাসে বসার জায়গা নেই। দাঁড়ানোও মুশকিল এত ভিড়রিপোর্টারের চোখ গেল সামনে ড্রাইভারের দিকে। তার পাশে থাকা ইঞ্জিনের উপর মালভূমির মতো আকারের উঁচু জায়গাটার দিকে। মানুষের জীবন্ত রক্তমাংসের দেয়াল ঠেলে ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রিপোর্টার অনেক কষ্টে সেখানে পৌঁছলেন। এবং বসেও পড়লেন। সামনে কাচের ওপারে দীর্ঘ যানবাহনে ভর্তি রাস্তাটা আগে আগে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রিপোর্টার অনুভব করলেন ভিড়ে থইথই বাসে কেন শুধু ইঞ্জিনের উপরটাই ফাঁকা। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা ঢাকার তোয়ালেটা বের করে সেই উষ্ণ তাওয়ায় রেখে তার উপর এবার আরাম করে বসলেন হঠাৎ বাসটা থেমে গেল। থেমে গেল তো থেমেই রইল। আর চলছে না। নিকট বা সুদূর ভবিষ্যতে আর চলবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

মিনিট দশেক হয়ে গেল। ড্রাইভারের দিকে তাকালেন রিপোর্টার। মুখের চামড়ায় বয়সের ছাপ। মাথা টাক। গায়ে রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জি। সুঠাম চেহারা। একমনে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। মুখমণ্ডলে ফুটে ওঠা ঘাম অথবা বিরক্তভাব যেন তোয়ালে দিয়ে ঘনঘন মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। রিপোর্টার সুযোগ বুঝে ক্যামেরা বের করতে করতে বললেনদাদা, জ্যাম সরতে কত সময় লাগতে পারে?

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ। হ্যাঁ।

ঠিক বলতে পারব না। গাড়িও খারাপ হয়ে থাকতে পারে। দেখতে হবে।... কোথা থেকে আসছেন?

এখানেই থাকি! রিপোর্টার।

তাই বলুন! আপনারা তো উপরতলার লোক!

কী যে বলেন! আপনি আমি উভয়েই মাস-মজুর।

তা আপনারা বাসে?

আর বলবেন না! আমাদের উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা!... দাদা, একটা প্রশ্ন করতে পারি?

বলুন! বলুন! রিপোর্টার প্রশ্ন করবে না তো কে করবে!

ক্যামেরাটা অন থাকলে কোনো অসুবিধা নেই তো?

নো প্রবলেম। দাঁড়ান, মুখের ঘাম মুছে নেই! এবার বলুন!

আপনার নাম?

গান্ধি!

মানে?

মানে আবার কী? সুরজলাল চম্পকলাল গান্ধিতিন পুরুষ ধরে কোলকাত্তায়।

তাই বলুন! আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম! আচ্ছা, জাতির পিতা গান্ধিজি সম্পর্কে আপনার কী মত?

কোনো মত নেই। কাম করি, খাই-পি নিন্দ যাই! তবে আমার রাজ্যের লোক ছিলেন। নমন জানাই।

তাও ওঁর আন্দোলন, মানে দেশের প্রতি অবদান, বর্তমান অবস্থা...

কীসব কঠিন বাংলা বলছেন! একটু সহজ করে বলুন! বাংলাটা ভাল বলতে পারলেও কঠিন কথা বুঝতে অসুবিধা হয়।

আচ্ছা। আচ্ছা। আমি বলছি ওঁর অহিংস আন্দোলন মানে হাতিয়ার না নিয়ে লড়াই করার বিষয়ে কিছু জানেন, বলতে পারবেন কিছু? এখন আমাদের দেশে ওঁর স্থান কোথায়?

বুঝলাম। শুনে রাখুন। হিংসা কোথায় নেই বলতে পারেন? সেই সুরজ ওঠার আগে থেকেই সারাটা দিন আমি এই ইঞ্জিন, এই বিরাট লোহার বাক্সটা নিয়ে কোলকাত্তার রাস্তার উপর লড়াই করি। আমার অত্যাচারে মাঝেমাঝে ইঞ্জিনটা এত গর্মি খায় যে মনে হয় ফেটে ঢাক্কন খুলে ওর কলকব্জা ছড়িয়ে ছিটকিয়ে পড়বে। এটা হিংসা নয়? ইঞ্জিনও আমাকে ছাড়ে না। এত্ত এত্ত তাপ আমার দিকে তাক করে ছাড়ে যে আমার সারাটা শরীর আগুন হয়ে ওঠে। এক পল আমি গাড়ি ছেড়ে নামতে পারি না। মাঝেমাঝে ভিরমি খাই। চোখ জ্বলে। মাথাও ঘোরে খুব ফির ভি লাস্ট স্টপ না আসা পর্যন্ত আমার ছুট্টি নেই। পিছনে দেখুন, আদমি আউর আদমি! একটু বসার জন্য একটু দাঁড়ানোর জন্য ঝগড়া করে যাচ্ছে। দেখুন বুড়া আদমি দাঁড়ানো। হেডফোন কানে গুঁজে ছোকরা জানলার পাশের সিটে ঘুমাচ্ছে। তার তাকত নেই নিজের জন্য জায়গা খুঁজে নেবার। আমি দেশ, আন্দোলন বলতে এইটুকু বুঝি আদমি বিনা হিংসা লড়াইয়ে কিছুই হাসিল করতে পারে নাআরে রোটি তোরনে কে লিয়ে ভি দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হয়! হিংসা কোথায় নেই! সারাদিন ঠান্ডা ঘরে বসে বসে আপনারা বিনা মতলবে শির্ফ চিল্লাতে থাকেন! কেউ কার কথা শুনতে চান না। বুঝলেও বোঝেন না। নিজের মত ভুল হলেও বিরোধীকে নাকাল করার জন্য গলা চড়িয়ে যান সবাই মিলেএগুলো হিংসা না?

কে বলল আপনি বাংলা ভালো বোঝেন না! থামবেন না বলতে থাকুন!

থাঙ্ক ইউ। তো যা বলছিলাম... জানি আপনি অন্য ফিল্ডে আছেন। আপনাকে এসব শোনানো হয়তো অন্যায়। তো আমার যতদিন তাকত আছে আমি এই ইঞ্জিন আর লোহার বাক্সটার সঙ্গে লড়াইয়ে হয়তো জিতে যাব। বুড্ডা হলে আর পারব না। তখন আমার ছেলে এই গাড়ি চালাবে। মালিকের সঙ্গে কথা পাক্কা করে নিয়েছি।

সব বুঝলাম বললেনও খুবই ভালোকিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল মহাত্মা গান্ধি সম্পর্কে আর আপনি শোনালেন নিজের কথা!

আরে দাদা, আমিও গান্ধি আছি! ভুলে গেলেন? আমার যা মনে আসল বলে ফেললামকিছু মনে করবেন না বুড়া লাগলে। আমার আর কিছু বলার নেই। আমার কী আউকাত ইতনা বড়া আদমি কে বারে মে কুছ বলুঁ। ফির ভি আর একটা কথা। বেটা আমার কথা শোনে না। বলে এই ভাঙা গাড়ি চালাবে না। বলে পুরাটা রিপেয়ার করাবে। এই লজঝর চিজ ওর নাপছন্দ। বোলে কিনা অটোমোবিল ইঞ্জনিয়ার হবে। নোতুন করে গড়বে সবকুছ। বলুন তো সামান্য ড্রাইভার আমি! আমার কাছে ইতনা রুপিয়া কাহা? মগর পঢ়াই মে মেরা বেটা বহুত হি আচ্ছা হ্যাঁয়।

ভালোই তো! তা নাম কী আপনার ছেলের?

সুভাষ গান্ধি

হঠাৎ সকাল থেকে সবাই আমার সঙ্গে ইয়ার্কি শুরু করে দিল কেন! কন্ডাক্টার ভাড়া নিন! আমি নেমে যাব!...   

No comments:

Post a Comment