বাক্‌ ১৫০ ।। অরিন্দম গোস্বামী

গেট টুগেদার

 

ঘড়িতে সময় তখন মোটে পৌনে ছটা। জানলায় তখনও রোদ এসে পড়তে খানিকটা দেরি আছে তারই মধ্যে সৌতির ডাকাডাকির চোটে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে বাধ্য হল অনিন্দ্য।

ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে এল সৌতি। আর এসেই পরপর প্রশ্নের ঝড় বইয়ে দিল, এখনও উঠতে পারোনি? এই তোমার জন্যে আমি কোন ভোররাতে উঠে বসে আছি? বিছানা থেকে নামতেই যদি এতটা সময় লেগে যায় তাহলে পরের কাজগুলো সারবে কখন? এই না বলছিলে যে সকাল সাতটার সময় তোমাকে নিতে গাড়ি আসবে?

পরপর প্রশ্নের মুখে মাথাটা খুলল অনিন্দ্যরমনে পড়ে গেল যে, আজকেই তো তাকে অনেকটা দূরে কবিতা পড়তে যেতে হবে সেই শামুকখোলা! উদ‍্যোক্তারা অনেক করে বলে গেছেন এই সাহিত্য উৎসব আয়োজনের কথা। উদ্বোধন করতে অবশ্য তাকে ডাকা হচ্ছে না। সেটা করবেন স্থানীয় কোনো হোমড়া-চোমড়া নেতাগোছের কেউকিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত তাদের মতো সাহিত্যিকরাও এইসব অনুষ্ঠানে খানিকটা গুরুত্ব পান কিছু বক্তব্য অথবা কিছু রচনা পাঠ করার জন্য। সাহিত্য উৎসবে যোগ দিতে নামজাদা সাহিত্যিকদের ডাক পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক।

তবে, অন্যান্য লেখকদের ছাপিয়ে উদ্যোক্তারা যে লেখক হিসেবে অনিন্দ্যকেই পছন্দ করেছেন তার একটা কারণ সম্ভাব্যরূপে এটাই যেঅনিন্দ্যর ছোটোবেলাটা কেটেছে ওই ছোট্ট গঞ্জমতো জায়গাটাতেই। এখনও খুঁজে দেখলে পাওয়া যাবে ওর চেনাজানা বেশ কিছু মানুষ, যারা এখনও ওখানেই বসবাস করেন।

এমনিতে সাধারণত রাতেই লেখালেখির কাজ করে অনিন্দ্য। ফলে সকালে সে ওঠে একটু দেরিতেই। আজকে তাই ও বেশ বুঝতে পারল যে, অনভ্যস্ত এই সময়ে ঘুমটাকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে গেলে শাওয়ারের তলায় বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে স্নান করতে না পারলে সে নিজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না।

পৌষ, মাঘ আর ফাল্গুন বাংলায় সাহিত্য উৎসবের এটাই মরশুম। মাঝে কলকাতায় বইমেলার জন্য গ্রামেগঞ্জে উৎসবের সাময়িক বিরতি। এছাড়া সপ্তাহে তিন-চারদিন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ। সব টায় হাজির হতে গেলে নিজের লেখালেখি সব লাটে উঠবে।

তবে শামুকখোলা থেকে ডাক এলে চট করে না বলতে পারে না অনিন্দ্যগতবারেও ওই একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে যে সমস্ত ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল সেগুলো এখনও পর্যন্ত ভুলতে পারেনি। তবুও একটা চোরাটান কেমন যেন টেনে নিয়ে যায়। পুরোনো দিনের কথা অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়, এখানে এলে।

সাহিত্যিক হিসেবে নামডাক হবার পর থেকেই সাধারণত নানান বয়সের পরিচিত লোকজন যে আবদার করে যেমন অমুক পত্রিকার সম্পাদক তার কতটা চেনাজানা, সেখানে লেখা প্রকাশ করতে ও কোনো সাহায্য করতে পারে কিনাএসব তো ছিলই। ছোটোবেলার বন্ধু সিন্টু যে একবার খেলার মাঠে ব‍্যাট হাতে ওকে তেড়ে মারতে এসেছিল (সে অবশ্য ছোটোবেলায়!)— সেই বা এই আবদার জানাতে পিছিয়ে থাকে কেন? বিশেষত, সেই সিন্টু যখন বর্তমানে শামুকখোলা পঞ্চায়েতের মাননীয় উপপ্রধান।

কিন্তু চমকে দিয়েছিল সিন্টুর মেয়ে। ওর জন্যে নিজের লেখা একটা ছড়ার বই নিয়ে গিয়েছিল অনিন্দ্য। সেটা একটু উলটেপালটে মেয়েটা সরাসরি বলে উঠেছিল, কাকু, এর থেকে একটা কবিতা আমি আমাদের স্কুল ম‍্যাগাজিনে দেব আমার নামে ছাপানোর জন্য?

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারেনি অনিন্দ্য। পরে ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, তার চেয়ে তুমি বরং এই ফুলের তোড়াটা নাও। এর ফুলগুলো তুমি ইচ্ছেমতো বিলি করে দিতে পারো, তোমার বন্ধুদের মধ্যে।

চারপাশে নতুন লাগানো আলুগাছের সারি। তার মধ্যেই ধ্রুবকুমার উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিরাট খেলার মাঠ। সেই মাঠেই এই সাহিত্য অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বেশ বড়োসড়ো একটা মঞ্চ। মঞ্চের নীচেই ঢাউস ঢাউস চারখানা সাউন্ড সিস্টেমের বক্স। সন্ধ্যায় হবে বিচিত্রানুষ্ঠান।

মঞ্চের দুপাশে অনেকগুলো স্টল। বইয়ের স্টল তার মধ্যে হাতে গোনা। একপাশে একটা হ্যান্ড ট্রাক্টর বিক্রির স্টল-ও ছিল। বেসরকারি একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানির স্টল-ও ছিল মাঠের একপাশে। কবিতা পড়তে উঠে অনিন্দ্য লক্ষ্য করেছিল, বসে আছেন বেশ কয়েকজন শ্রোতা। কিন্তু কেউই যেন কিছু শুনছেন না। 

ফেরার মুখে সংগঠকদের একজন হাতে খামটা তুলে দিয়েছিল। বলেছিল, একটু দেখে নিন।

এবারের যা ভাবগতিক পাওনাটা আরও একটু বাড়তে পারে।

বাইরে থেকে হঠাৎই দরজায় ধাক্কা। সঙ্গে সৌতির চিৎকার, চান করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? গাড়ি এসে যাবে তো!

চমকে উঠে ধাতস্থ হয় অনিন্দ্য। শাওয়ারের তলায় উদোম হয়ে কি এত আকাশপাতাল ভাবছে ও? শাওয়ারটাই তো চালানো হয়নি এখনও!

 

5 comments:

  1. সুন্দর ছোটো গল্প। ভাবের ঘোরে খাম পেলেও মন্দ কি!

    ReplyDelete
  2. ভাবছিলাম কোথায় সেই চাবি? পেলাম যখন বেশ মজা পেলাম। শেষে সেটাই আমাদের মত লেখকদের ভাবিয়ে তুলল । ভালো ।বেশ ভালো ।

    ReplyDelete
  3. বেশ ভালো লাগল। একটানে শেষ করলাম।

    ReplyDelete
  4. দারুণ লাগল।

    ReplyDelete
  5. দারুণ এবং একেবারে অন্যরকম।

    ReplyDelete