বাক্‌ ১৫০ ।। অনুসরণমঙ্গল- ৮ ।। শুভংকর গুহ


 

 

জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। সাগরের জলের তরঙ্গের মতোই জ্যোৎস্নারও তরঙ্গ আছে, কিন্তু শব্দহীন। মাঠঘাট পথঘাট ঝোপঝাড়ে আলোর তরঙ্গ তুলেছে। ক্রমশ শীতল হচ্ছে চারধার। বেলঘরের দিকে যাওয়ার মাটির পথের ওপরে চা জল পানীয়র পান্থশালা, পঞ্চনন্দ ঠাকুরের মন্দির, জোড়া শিবমন্দির, দোকানপাট, ক্রমশ গড়ে ওঠা রেলপথ, চাটুজ্যেদের বাগানে মাটি ফুঁড়ে ওঠা মাস্তুল, নোঙর, দানবীয় লোহার শিকল, বহুদূরে প্রাচীনতর বৃক্ষগুলির থোকা থোকা জমাট অন্ধকার কেমন স্তব্ধ, থেমে আছে রাত্রি চাঁদের আলোতে স্তূপ স্তূপ বিমূর্ত বিবরণ মানুষের যুগ যুগান্তরের কতশত ধারণা ভাবনা, সভ্যতার ইতিহাসের ঘৃণা – অহংকার। কোনোটি সাময়িক সজীব আবার কোনোটা অপাংক্তেয়। একজন ছায়া মানুষের মতো জলাশয় থেকে ধবধবে সাদা উঠে এসে, জল শিউলি ছড়িয়ে দিয়ে গেল, হোপলে মাছ ফাঁসবে। গভীর রাতে মঙ্গলকাব্যের পৃষ্ঠা থেকে উঠে এসে, পুকুরের ঘাটে চাউল ধুয়ে নিয়ে ফিরে যাবে কুটিরে ভিনদেশি অতিথির জন্য। রন্ধন হবে মধ্যরাতের সামান্য আয়োজনের উষ্ণতা।

ফিঙ্গের দিকে চলেছে পালকি, পালকির ভিতরে জীবন্ত কাহিনি বা গল্প আরবি ঘোড়ার নালের খুঁট খুঁট শব্দে বুনে যাচ্ছে আগামী দিনের জীবন যাপনের ঘরকুটির। এক কাহার... দুই কাহার... তিন কাহার... চার কাহার... একটি অন্ধকার তেঁতুল গাছের নিচে, পালকি নামাল কাহার, তখন ওই যে ওরা আসতেছে। দেঁতের খাল ধরে, ছিপ নৌকাগুলিকে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে। রক্তচক্ষু ওদের। শববাহকের দলটি আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল।

বলল,-- আড়িয়াদহ শ্মশানে যাচ্ছি। ফড়ে শয়তান তমোনাশের শব আছে। শব ছাড়া আর কিছুই নাই। একবার দেখে যাও...

ধুব ধুব ছুটে যাচ্ছে লুটেরা শয়তানের দল। অন্ধকারে ডাকাতির দাগ দিচ্ছে। পতিতপাবন ঘোষাল মাথা দোলাতে দোলাতে হেঁটে যাচ্ছে, যেন সঙ্গীতের রাগ তার ভিতরে ছন্দ পেতেছে।

দিগম্বর চিৎকার করে উঠল,-- কোনদিকে হুজুর ?

পতিতপাবন উত্তর দিল,-- বেনারসের ওস্তাদকে দেখতে যাচ্ছি।

কেশবনন্দন বলল,-- দেখ নিবারণদা কত চমৎকার ঘটে যাচ্ছে। প্রতিদিন রাতে, আমরা ঘুমিয়ে থাকি, জানতেও পারি না।

নিবারণ হাসতে হাসতে বলল,-- ওরা আমার লাঙ্গল বিদ্যার অনুসরণকে প্রশ্ন করল।

 দিগম্বর... দিগম্বর... চিৎকার করে বলে উঠল... দেখ ডিঙ্গি কেমন দেঁতের খালের ওপরে দুলে যাচ্ছে। চলো আমরা ডিঙ্গিটিকে প্রশ্ন করি। প্রশ্ন করে দেখি, উত্তর পাওয়া যায় কি না ?

কীসের প্রশ্ন ? কোন প্রশ্ন ?

নিবারণ জ্যোৎস্নার কাছ থেকে আরও আরও আলো ঋণ করে বলল,-- অনুসরণের আর বিদ্যার আগে পরে কোনো প্রশ্ন হয় না দিগম্বর।

No comments:

Post a Comment