বাক্‌ ১৫০ ।। কৌশিক মিত্র

পলাতক       

 

=১=

 

সামনের পথ বেয়ে এগিয়ে চলে গোলাম। এ পথ একখানা বাঁধের উপর দিয়ে, সোজা এগিয়ে গেলে দামোদর— তা প্রায় হেঁটে গেলে ঘণ্টা দেড়েক, পিছু ফিরে নাকবরাবর হাঁটা দিলে দেখা মিলবে রূপনারায়ণের সেও প্রায় এক ঘণ্টার রাস্তা। রূপনারায়ণের কাছেই চর কাঁটাপুকুর গ্রামখানা। গোলামের ভিটে। এ নয় যে গোলাম একটা রিকশা নিতে পারত না সে নেয়নি, সে দেখে নিতে চাইছিল চল্লিশটা বছরে কতটা বদলে গেছে তার ফেলে যাওয়া পৃথিবী! বাঁধের গা বরাবর গাঁদা ফুলের চাষ, মাঝে বিরতি, ফালি জমিতে ভ্যাকুয়াম বল পেটাচ্ছে ছেলেরা। মধ্যিখানে মাঝারি চওড়া একটা খাল মিডনাপুর ডিচ সেভেন এ খাল দামোদর আর রূপনারায়ণকে জুড়ে দিয়েছে খালে নাকি আগে আসত সদাগরি নৌকো! গোলাম সেসব দেখেনি সেসব প্রাক ডিভিসি পর্বের অনেক আগের কথা। বাঁধের চারপাশে ঝুপড়ি, মাঝে মাঝে চায়ের দোকান, এসব ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে গোলাম রাস্তায় নেই কোনো চেনা মুখ! অপূর্বর বাড়ি এখনও বেশ কিছুটা। গোলামের চোখে ভেসে ওঠে চারকাঠা জমি, আব্বা আর রূপনারায়ণ। এগিয়ে আসছে রূপনারায়ণ, চর জাগছে কোলাঘাটের ওদিকে, হাজরাদের বিঘের পর বিঘে গ্রাস করছে দানবীয় নৃশংসতার সঙ্গে, আব্বা সন্ত্রস্ত, “আর যে কিছুই থাকলনি রে লাল...”, “রূপনারায়ন, রূপনারায়ন শুধু কি নিয়েছ জমি, নিয়েছ ত আমার আব্বুকেও”। গোলাম বিড়বিড় করতে থাকে...

“আরে কে ও গোলাম নাকি? কেমন আছ বাবা? কবে এয়েচ?” আহা এতদিন পরে কে ডাকে তাকে এ নামখানা ধরে! পরনে লুঙ্গি গায়ে খাদির বিবর্ণ পাঞ্জাবি, হাতে ছাতা, এক বৃদ্ধ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে।

কি বাবা চিনতে পারলেনেকো? আমি গদাইকাকা” এক লহমায় গোলাম পিছিয়ে গেল বছর পঁয়ত্রিশ আগে। বেশ ছিমছাম একটা মনিহারী দোকান ছিল গদাইকাকার, এ এলাকার প্রাচীন সিপিআই, হাজার অনুরোধ এবং ধমকানিতেও কংগ্রেস বা সিপিএম কোনটাতেই ঢোকেননি। ১৯৫৫-য় বুলগ্যানিন আর ক্রুশ্চেভ ভারতে আসার পরে পরেই গদাইকাকার ছেলে হয়েছিল, নাম রেখেছিল বুলগ্যানিন! বুলগ্যানিন বোস। স্কুলে গোলামদের বড় অনুগত ছিল সেই বুলগ্যানিন! গোলাম নীচু হয়ে গড় করল “কাকা, বুলগ্যানিন কোথায়? কেমন আছে? কী করে এখন?”

“সে এখন এলআইসির মস্ত এজেন্ট হয়েছে বাবা, দোকানে আর বসলেনেকো আমাকেই এখন প্যালা ঠেলতে হচ্ছে। বাংলাদেশে থাক, শুনিছিলুম। তা বাবা, চললে কোথায়?’’

“অপূর্বর বাড়ি।”

“নাটক কর ত বাবা এখনও?”

“না, কাকু সেসব আর...’’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল গোলামের বুক ভেঙে

“না না না, ওটি ছাড়লে চলবে কেন? দরকারে ফাঁকা ঘরে একা একা নিজেকে বাজিয়ে নেবে! তা এস বাবা বিকেলে মনে করে দোকানে, কতদিনের পুরনো কথা সেসব! আমাদের মনসুরের ব্যাটা তুমি! একেবারে বিবাগী হয়ে গেলে কি করে হবে বাবা? দেশ পাড়াগাঁ ত এই করেই উচ্ছন্নে গেল!”                                           

 

=২=

 

গোলাম মুস্তাফা একটা মুছে যেতে থাকা অতীততার জন্মভূমি তাকে ভুলে গিয়েছে, পাড়াতুত তিন চাচার সঙ্গে দুবছরে দু’-তিনটে চিঠি ছাড়া সে যোগাযোগশূন্য, হালে অবশ্যি ফোন এসেছে। আশেপাশের প্রতিটি গ্রামেই ছিল তার অবাধ গতিবিধি, সে ল পড়েছিল সুরেন্দ্রনাথে, শিক্ষানবিশী শুরু করেছিল হাওড়া কোর্টেমনসুর, তার আব্বু বুঝে গিয়েছিল বেলা ঘনিয়েছে, ছোটবেলা থেকে মা হারা ছেলেটাকে বড় আদরে মানুষ করেছিল, নাম রেখেছিল লাল, বড় ফর্সা ছিল গোলাম! সময় থাকতেই ছেলেকে ঢাকায় শালার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল মনসুর। গোলাম, সে শিশির ভাদুড়ী হতে চেয়েছিল, সে আলমগীর মঞ্চস্থ করেই ছেড়েছিল, সে আলমগীরকে  ড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, সে কলকাতাকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল, গ্রামের ছেলেরাও নাটকে পিছিয়ে নেই আর, দিনরাত জেগে সে আর অপূর্ব, অপূর্বদের বাড়িতে বসে পড়াশুনা করত, মেক আপের উপর, আলোকসজ্জার উপর বই কিনে আনত, গুপির সঙ্গে বসে সুরের কম্পোজিশন বানাত! গোলামের শিশির ভাদুড়ী হয়ে ওঠা হয়নি! চুয়াত্তরে, মনসুর মারা যাবার আগেই গোলামকে ঢাকায় স্থিতু হবার প্রক্রিয়া শুরু করে দিতে হয়েছিল! আব্বুকে ছাড়া সে কি করে কাটাবে সে! এই আতঙ্কই তাড়া করেছিল তাকে! তার আব্বু থাকলে কি সে যেত এত সহজে? ঢাকা শহরে নয় নয় করে তিরিশটা বছর কাটিয়েও ঢাকা আজও তার কাছে বিদেশ, বন্ধুমহলে সে ঘটী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়! আটাত্তরের বন্যা ভাসিয়েছিল তার ভিটে, খুব কষ্ট করে সে সময় আকাশবাণী ধরত সে, বারবার চিঠি লিখত রসুল চাচাকে! আগের চারটে বছরে রূপনারায়ণের গর্ভে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছিল মনসুরের জমি! আটাত্তরে গেল বাড়িটুকুও! সেই বাস্তুভিটেতে উঠেছে একখানা ক্লাবঘর। গোলাম সে ঘরে বসে, রসুলের ছেলে নাসিম এসে বসে পাশে। এস এসসি দিয়ে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে নাসিম, ইংরেজি পড়ায়।

“নাসিম, তোমরা নাটক কর না?”

“দাদা, আপনাদের সময়ের মত নাটক এখন আর হয় না, নাটক ব্যাপারটাই প্রায় উঠে গেছে, যাত্রারও অবস্থাও খুবই খারাপ! এখন পুজোপার্বণে পাড়ায় পাড়ায় অর্কেস্ট্রা আর ড্যান্স ট্রুপ!”

“অর্কেস্ট্রা! সে কী জিনিস?”

“সেটা আর কিছুই নয়, কিশোর রফির কিছু হিট গান আর হালের হিন্দি কিছু গান আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে নকল করে গাওয়া, আর পাবলিকের নাচ”

গোলামের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল। “আচ্ছা শ্যামপুরের নাটক প্রতিযোগিতা, শরৎ মেলার প্রতিযোগিতা সেগুলো হয় না এখন?”

“শ্যামপুরের নাটক প্রতিযোগিতা বহুদিন উঠে গিয়েছে দাদা, আর শরৎ মেলায় যে সব নাটকের কথা আগে শুনতে পেতুম, এখন আর পাই না! অবশ্যি খবরও রাখি না সেভাবে।”

এক অসহ্য শূন্যতা গোলামকে গ্রাস করে নিতে থাকে।

 

=৩=

 

১৯৭০-এ গোলামরা কজন মিলে যে নাটকের দলটা করেছিল তার পিছনে ছিল দেবাশিস রায়। একেবারেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিল না দেবাশিস, কিন্তু হল ভাড়া করা, প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়া, এসবের পিছনে থাকত তারই হাত-দলের নামকরণ ফৌজ এটাও দেবাশিসেরই করা, সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন করানো সেখানেও দেবাশিস। বাহাত্তরে বিসিএস পেয়ে বেরিয়ে গেল দেবাশিস, গোলামের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। গোলাম ভোলেনি অগ্রপথিককে। গুটি গুটি পায়ে গোলাম খোঁজখবর নিয়ে পৌঁছে গেল সার্ভে বিল্ডিংয়ে, তিনতলার গলিঘুঁজি পেরিয়ে একটা চেম্বারে। পিয়নকে নিজের একটা কার্ড ধরিয়ে অপেক্ষমান গোলাম দেখল, বোর্ডে ঝুলছে তার অগ্রজপ্রতিম দেবাশিসদার নাম, জয়েন্ট ডিরেক্টর, ডাইরেক্টরেট অব ল্যান্ড রিফর্মস অ্যান্ড সার্ভে, গভর্নমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল। পিয়ন ফিরে আসে, ‘‘আসুন সাহেব ডাকছেন।’’ সেক্রেটারিয়েট টেবিলের অন্যদিকে এক চেয়ারে বসা এক জবুথবু ব্যক্তি! সুবিশাল টাক, মাথার পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া কয়েকগাছি সাদা চুল, গাল দুখানা তুবড়ে গেছেএ কোন দেবাশিস রায়! দেবাশিস ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে গোলামের দিকে। স্তব্ধতা ভেঙে দেয়, গোলাম।

“আমি গোলাম, দেবাশিসদা, চিনতে পারছ না?”

দেবাশিস, কার্ডের উপর চোখ বুলিয়ে ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। “গো গো গোলাম! মানে আমাদের চরকাঁটাপুকুরের গোলাম...”

“তুমি এত অবাক হচ্ছ কেন, দেবাশিসদা?”

দেবাশিসের বিস্ময়ের ঘোর কেটে যেতে থাকে।

“আরে ভাই তোমার সঙ্গে শেষ দেখা বাহাত্তরে, আজ দুহাজার চার, বাড়ি যখন গেছি তখন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, ছিয়াত্তরে শুনলুম তুমি এখান থেকে চলে গিয়েছ! এলে কবে? উঠলে কোথায়? একটা খবর দেবে ত!”

“খবর কাকে দেব? গত বছর হঠাৎ ঢাকায় সুবীরের সঙ্গে দেখা, ওই তোমার অফিসের ঠিকানা দিল।”

“কোন সুবীর?’’

—‘‘আমদের বাগানবেড়ের সুবীরওর এক মাসি থাকে ঢাকায়, সেই সূত্রে বেড়াতে গিয়েছিল। রাস্তায় হঠাৎ দেখা। নাহলে ত কারুর খোঁজখবরই পেতাম না।”

“ওহ! সুবীর! সে ত পিডব্লিউডিতে আছে এখন। বছর চারেক আগে এসেছিল, মেয়েটাকে গোখেলে ভর্তি করাতে চায়ত আমি ওকে অপূর্বর কাছে পাঠিয়ে দিলুম। সুবীর ত অনেকদিন আগেই দেশছাড়া, সরশুনা মানে ঐ বেহালার দিকে ফ্ল্যাট কিনেছে।”

“অপূর্বর কি খবর দেবাশিসদা, আর কবি মানে প্রিয়তোষ?”

“অপূর্ব এখন এডুকেশনে ওএসডি। বাড়ি থেকেই যাতায়াত করে। আমাদের ‘ফৌজ’ এখন ওই টানছে, কিছু ভুলভাল ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তোমরা যে ভাবে শুরু করেছিলে সে সব আর কিছুই নেই।”

দেবাশিসের টেবিলে ফোনটা বেজে উঠল।

“স্যার, স্যার... সিওর স্যার। স্যার! আমি ডট তিনটের মধ্যেই ঢুকছি!”

দেবাশিসের ইঙ্গিতে পিওন দু কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে ঢুকল।

“কিছু খাবে, গোলাম?”

—‘‘দেবাশিসদা, তুমি কিন্তু আমাদের তুই করেই ডাকতে।”

দেবাশিস হেসে ওঠে, এই বারে বুঝি গোলাম তাকে নাক্ত করে।

কাপ আর প্লেটের ঠুঠা আওয়াজ, উপর থেকে সিলিং ফ্যানের একটানা ঘড়ঘড়ানি

“নিজের বিয়েতে ত আর জানাতে পারিনি দাদা। ছেলেদের বিয়েতে কিন্তু ঢাকায় আসতেই হবে। বড়টা ময়মনসিং মেডিক্যাল কলেজ থেকে পা করে প্র্যাকটিস করছে, আর ছোটটা এমএসসিতে ভর্তি হয়েছে। তোমার খবর ত শোনালে না দেবাশিসদা!”

“বাহ! তুমি ত খুব ভাল খবর দিলেআজকে উঠতে হবে ভাই। মন্ত্রীমশাইয়ের জরুরি মিটিং। পৌনে তিনটের মধ্যে রাইটার্সে ঢুকে ব্রিফটা ধরিয়ে দিতে হবে

দেবাশিস উঠে দাঁড়িয়েছে।

আলাপের সুরটা যেন দুম করে কেটে গেল। গোলাম হাজরা পার্কে ঢুকে খানিকক্ষণ বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকল। দেবাশিসদা ত ওকে একবার তার বাড়িতে যেতেও বলল না! দেবাশিসদা কি ভাল নেই? গোলাম মেট্রোয় উঠল, ধর্মতলায় নেমে সে জনারণ্যে হারিয়ে গেল

 

=৪=

 

অপূর্বর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে গোলাম। একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে দরজা খোলে, মুখে নিষ্পাপ হাসি

—‘‘অপুর্ব আছে?’’

—‘‘বাবা ত বেরিয়েছেন একটু। ফিরতে দেরি হবে। আপনি কোথা থেকে আসছেন?”

গোলাম থমকাল। “আমার নাম গোলাম মুস্তাফা। আমি তোমার বাবার বন্ধু হই, বাবা! এখন বাংলাদেশে থাকি

“আসুন, আসুন। আপনার কথা ঠাকুমার মুখে শুনেছি।”

“বাড়িতে কে আছেন বাবা?”

বসার ছোট ঘরের দিকে গোলামকে নিয়ে যেতে যেতে ছেলেটি বলে “এখন আমি আর ঠাকুমা বাড়িতে আছি।”

“তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়ছ বাবা? কোন ক্লাস?”

“আমার নাম অরুণাশিস, ডাক নাম বাবাই। আমি জনকল্যাণ উচ্চতর বহুমুখী বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ি।”

“আমরাও ত ওখানেই পড়েছি। আমাদের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন তারিণীবাবু! আমাদের সময়ের আর কেউ বোধহয় এখন নেই।’’

“না, আপনাদের সময়ের কেউ এখন আর নেই।’’

“আমাদের ইংরেজির মাস্টারমশাই ছিলেন শশাঙ্কশেখর সতপতি, নাউল থেকে আসতেন। সেভেন থেকে আমাদের আরবি নেওয়ার চল ছিল। তিনটে সেকশন মিলে প্রায় চল্লিশ জন ছাত্র, টিফিনের আগের ক্লাস। মৌলবীস্যার সেদিন স্কুলে আসেননি। আমরা ত মনের আনন্দে গণ্ডগোল করছি। হঠাৎ হেডস্যার তারিনীবাবু শশাঙ্কবাবুকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। মৌলবীস্যারের শরীর খারাপ, সপ্তাহ দুই আসবেন না, আজ শশাঙ্কবাবু তোদের আরবির ক্লাস নেবেনআমরা অবাক। সত্যি কথা বলতে কি শশাঙ্কবাবু সেদিন আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। কে জানে, স্যার বেঁচে আছেন কিনা?”

“আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি ঠাকুমাকে ডেকে নিয়ে আসি।”

গোলাম ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই ঘরে রয়ে গেছে চল্লিশ বছর আগের আড্ডার উষ্ণতা, ঘরের সেরকম কিছু পরিবর্তন হয়নি কয়েকবার চুনকাম হওয়া ছাড়া। দেওয়ালে নোনা লেগেছে, গায়ে তার অসংখ্য দ্বীপ, বদ্বীপ।

“কেমন আছ বাবা?” অপূর্বর মা, চায়ের কাপ-প্লেট নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। চলে কুশল বিনিময়ের পালা। ওঠে অপূর্বর কথা, মা বলে চলেন, “বোনেদের বিয়ে দিতে গিয়েই ছেলেটা বুড়ো হয়ে গেল। তারপর তোমার মেসোমশাইকে নিয়ে চলল যমেমানুষে টানাটানি, তিনি থাকলেন না। এই ত বছর খানেক আগে ছেলেটার বিয়ে হল...”

কথা যেন শেষ হয় না। বাবাই যোগ দিয়েছে গল্পে।

দরজায় কড়া নড়ে উঠল। ‘বাবা এসেছে’’— বাবাই ছিটকে গেল।

পূর্ব বাড়িতে ঢুকল।

“বাবা, কে এসেছে জান?”

“কে রে?”

“গোলাম কাকু।”

“সে কে?”

“সেই যে যার সঙ্গে তুমি নাটক করতে, যাকে নিয়ে সেজপিসিমণির জন্য ছেলে দেখতে গিয়েছিলে। এখন বাংলাদেশে থাকে।”

অপূর্ব একটু চমকে উঠল। “চল ত দেখি!”

 

=৫=

 

ছোট বসার ঘরখানায় ঢুকল অপূর্ব, “আরে, অপূর্ব এস এস! কেমন আছ ভাই?”

“গোলাম যে! কখন এলে?”

“এই ত খানিক আগে, তোমার ছেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, মাসিমার সঙ্গে কথা হল। কি যে ভাল লাগছে! বল, তোমার খবর বল।”

“আমাদের আর খবর! সেই থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। সকালে উঠে দুটো নাকেমুখে গুঁজে সাড়ে আটটার সুপার! অফিসটাকেও দিলে সল্টলেকে ঠেলে! কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত্রি দশটা!”

“তুমি ত কলকাতায় থাকলে পারতে!”

“না ভাই, এই বেশ! কলকাতা আমার পোষায় না। চা খেয়েছ?”

গোলাম নিজের কথা বলে চলে। একটা অদ্ভুত নৈরাশ্য, অসহনীয় শৈত্য দুজনের কথাবার্তার ফাঁকে তিরিশটা বছর গিয়েছে পার!

“এখানে পুরনো কারুর সঙ্গে দেখা হল?”

“দেবাশিসদার সঙ্গে অফিসে গিয়ে দেখা করলুম

“কেমন আছে দেবাশিসদা? কিরকম দেখলে?”

“বড্ড বুড়িয়ে গেছে দেবাশিসদা? ভালো করে কথাও বলতে চাইল না! কি ব্যাপার বল ত?”

“দেবাশিসদার লাক খুব খারাপ ভাই। বউদি বাইপোলার ডিসর্ডারে ভুগছে। ছেলেটা অটেস্টিক। মেয়েটা পড়াশুনোয় খুব ভাল, ওকে নিয়েই দেবাশিসদা বেঁচে আছে।”

“ইশশশ্‌! কবি, কবি কেমন আছে বল দিকি!”

“ভাল নেই ভাই, কবিও ভাল নেই। কবি থাকে সল্টলেকের শ্যামলীতে। বউয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, ছেলেটা ক্লাস এইটে বিডিতে পড়ছে!”

“নাহ! আজকে উঠতে হবে ভাই, বিজেডসিএর একটা মিটিং আছে চারটেয়, বেরুতে হবে। এসব নিয়েই আছি আর কি!”

গোলাম হাসে। একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিল অপূর্বর হাতে “একদিন এস না ভাই ঢাকায় বউদি ছেলেকে নিয়ে। কতদিন আড্ডা দেওয়া হয়নি!” অপূর্ব উঠে দাঁড়িয়েছে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি! গোলামকে সে কিছুদুর এগিয়ে দিল।

 

“বাবা তুমি, গোলামকাকুকে থাকতে বললে না কেন?”

“আ! তুই বড় বাজে বকিস” তীব্র বিরক্তির ছাপ অপূর্বর গলায়!

“কি সুন্দর পুরনো গল্প বলছিল তোমাদের। বলল বাবাকে বলো ঢাকায় নিয়ে যেতে। খুব ভালো লোক, বল?”

“দেখ বাবাই, তোকে আমি বারণ করেছি অপরিচিত লোকের সঙ্গে বকবক না করতে!”

“এ ত অপরিচিত লোক নয় বাবা!”

“তুই কি করে জানলি যে এ লোক গোলামই! কি প্রমাণ আছে? আর যদি হয়ও, তিরিশ বছর পর সে কোথায় থাকে, কি করে কিছুই না জেনে তোকে তার সঙ্গে বকবক করতে বলেছে কে? দিনকাল ভালো নয়, জানিস না? এ যে আইএসআই-এর এজেন্ট নয় তার কোন নিশ্চয়তা আছে? এভাবেই ত সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে এরা খবর জোগাড় করে!”

“না! না আ আ আ আ...” বাবাই আর্তনাদ করে ওঠে।

অপূর্ব কলঘরে ঢোকে। বালতিতে জল পড়ার আওয়াজ শোনা যায়!

 

=৬=

 

গোলাম ফিরছে সেই বাঁধের রাস্তা ধরে, সে ভেঙে যাচ্ছে, পর্ণমোচী বৃক্ষের মতোই মনের মধ্যে জমে থাকা টুকরো আশাগুলো পাতার মতো নীরবেই খসে যাচ্ছে! এ কোন দোজখে এসে সে পৌঁছে গেল! তিরিশ বছর ধরে তিলতিল করে সে এখানে ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছে! এরকম ফেরা, ত সে চায়নি! স্মৃতির সরণি বেয়ে এই ছিন্নভিন্ন মৃতের নগরীতে আসার জন্যেই কি তার জীবনের অর্ধেক সে কাটিয়ে ফেলল! এসব চিন্তায় সে বিধ্বস্ত হতেই থাকল!

একটি অলস দুপুর! নাম না জানা পাখির কূজন “টুই-টুই!’ অখ্যাত গ্রামের অখ্যাত এক কবরস্থানঝোপে ঝাড়ে ঢাকা। কয়েকটা ধাড়ি ছাগল বাড়ি ফেরার জন্য মালিকের অপেক্ষায়। এখানেই শুয়ে আছে মনসুর। গোলাম পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় সে কবরে। খোদাতালার কাছে মোনাজাত শেষ করে সে বসল একটা পাকুড় গাছের নীচে! তার চোখ দিয়ে নামছে অশ্রুধারা! “আব্বু! আব্বু! বলে দাও আমায়, আমি এবার কোথায় পালাব? কোথায়? কোথায়?”

 

No comments:

Post a Comment