বাক্‌ ১৫০ ।। অভিষেক মুখোপাধ্যায়


 

স্বপ্নচরের ছিটমহল

 

 

অতিকায় মরচে-ধরা বঁড়শি নেমে আসে নিস্তব্ধতার মহামঞ্চে

যেভাবে প্যাথোজেন নামে শাশ্বত কোষের‌ ভেতর

সোডিয়ামের আলোয় একটা একটা করে নক্ষত্র মুছে যায়

রূপান্তরকামী আকাশ থেকে

ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্রের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় সরাইখানায়

সামরিক নির্দেশে ছাদ থেকে প্রকান্ড ব্যানার বয়ে নামায়

তিনজন অপাপবিদ্ধ দেবশিশু 

আর কীটনাশকের গন্ধে ভারী হয়ে থাকে বাতাস

 

রক্তের দাগ রঙ বদলায় রাত নটায়

অনুশাসনসম্মত স্বপ্নচরদের কুচকাওয়াজ এগিয়ে আসে

যাদের নামে জয়ধ্বনি দেয় দশ হাজার দর্শক

উন্মাদ জেরেনিয়ামের বিস্ফোরণ ঘটে অপকীর্তির পরিত্যক্ত অ্যাসাইলামগুলোতে

ভয়াবহ অসুস্থতা আচ্ছন্ন করে ট্র্যাপিজ-শিল্পীদের

আর মর্স কোডে কথা বলতে শেখেন‌ বৃদ্ধ তামাক-বিক্রেতারা

 

আমি ঘুমিয়ে পড়ি আমার ঠান্ডা কুঠুরিতে

বৈদ্যুতিক ভেড়া আর সিরিঞ্জের ছুঁচের স্বপ্নের ভেতর

বাতিকগ্রস্ত জাদুকরদের গোপন আস্তানায়

স্যাঁতস্যাঁতে সংবাদপত্রের ওপর আঁকা থাকে অশুভ চিহ্ন

আর তাদের জিভ শয়তানের ভাষায় স্বয়ংক্রিয় হয়

রাত তিনটে বেজে সাঁইত্রিশ মিনিটে

 

মন্ত্রমুগ্ধ যুদ্ধবাজদের উপত্যকায়

জখম সম্রাজ্ঞীর মত লুটিয়ে পড়ে রাত্রি।

 

 

 

মাংসাশী রাতপোশাক

 

 

পরিত্যক্ত বাড়ির গাঢ় নীল চিলেকোঠায়

মাংসাশী হয়ে উঠেছে একটা রাতপোশাক

রাত নিস্তব্ধ হলে তার হাড় চিবোনোর আওয়াজ আসছে

ঠান্ডা কালাশনিকভের মত হাওয়ায়

জানলা দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শহরে

নিখোঁজ মানুষের পোস্টারে ঢেকে যাচ্ছে প্রতিটা শৌচালয়ের দেওয়াল

আর বাধ্যতামূলক ঘুমের ভেতর জ্বেলে রাখা হচ্ছে

জোরালো সার্চলাইট

 

এরকম রাতে সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে অভিশপ্ত জাদুঘর

কোথাও কান্না শোনা গেলে ভারী জুতোর শব্দ

ছড়িয়ে পড়ে সন্ত্রস্ত অলিগলিতে

সব ঘড়ি একসঙ্গে থেমে যায় অব্যর্থ সময়ে

অন্তঃসত্ত্বা‌‌ বেড়ালের মত সতর্ক হয়ে থাকার চেষ্টা করে

জেলখানার ন্যুব্জ কয়েদিরা

কিন্তু আজ তাদের চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে

আর কানের ভেতর থেকে গজিয়ে উঠছে ভয়ার্ত টিউলিপ

 

বৈদ্যুতিক চুল্লি উপচে পড়ছে মৃত জোনাকির ডানায়

অশীতিপর বৃদ্ধ মেগাফোন‌ হাতে আওড়াচ্ছেন সব নক্ষত্রপুঞ্জের নাম

যদিও তাঁর কন্ঠস্বর ডুবে যাচ্ছে টিভির শীৎকারে

আর ঘৃণ্য ভুক্তাবশেষ‌ পড়ে থাকছে

হাসপাতালের আবর্জনা ফে‌লার পাত্রে

 

গতকাল উচ্ছেদপত্র পেয়েছিলেন মুমূর্ষু ঈশ্বর

আর আজ রান্নাঘরের চিমনির তলায়

তিনি কুড়িয়ে পেলেন একজোড়া রক্তাক্ত দস্তানা।

 

 

 

দু'জন লোক

 

 

একজন লোক শুক্রবার অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তার কুকুরদের কিনে দিলো বিস্কুট

আর তখনই আকাশ‌ ভেঙে নামলো শর্তহীন বৃষ্টি!

তার রেনকোট ব্যাগেই থাকলো, ইচ্ছে করেই ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরলো সে।

ফেরার পথে রাস্তার জমা জলে লাফালো বারকয়েক ফর্মাল জুতো পরে,

'বয়স কি কমছে?' প্রশ্নের উত্তরে দাঁত বার করলো যেন আস্ত নির্বোধ,

চায়ের দোকানে কেক খেলো,

খবরের কাগজ দিয়ে‌‌ নৌকো‌ বানিয়ে ভাসালো অভিমানী রাস্তায়,

বাড়ি ফিরে ভিডিও গেমে জম্বি মারলো ঘন্টাখানেক আপন মনে,

রাতে খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়লো শিশুর মত।

 

আর একজন লোক উটকো উন্মাদের সাথে হাতাহাতি লাগালো অফিস থেকে বেরিয়েই,

পায়ে চোট লাগালো, তারপর একটা শাট্‌ল নিয়ে

সোজা চলে গেল নিকটতম বারে।

সেখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পর্দা ঠেলে ঢুকে

কোনার টেবিলে বসে অর্ডার করলো তিনটে লার্জ‌ হুইস্কি আর দুটো বীয়ার।

সব ফোন‌ কল অগ্রাহ্য করলো বসে বসে,

বাথরুমে গিয়ে খুব কাঁদলো‌ একবার

কিন্তু বেরোলো শুকনো চোখে।

বার বন্ধ‌ হওয়ার সময় টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়ালো সে,

ঠোঁটের কোণ থেকে জ্বলন্ত সিগারেট খসে শার্টে ফুটো হলো

সে খেয়ালও করলো না।

কাকে যেন‌ বার বার ফোন করলো কিন্তু উত্তর পেলো না!

চীৎকার করে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে

ট্যাক্সি ডাকলো মাঝরাতে।

 

কোনো কোনো বৃষ্টিস্নাত বিকেলের মরে আসা আলোয়

একটা নির্দিষ্ট সময় একটা নির্দিষ্ট উষ্ণতায়

শুধু একটা নির্দিষ্ট কোণ থেকে দেখলে

তবেই বোঝা যায়

যে ওই দু'জন লোক আসলে একজনই।

 

1 comment:

  1. বেশ ভাল লাগল আপনার কবিতাগুলি ।মন ভিজে গেল।

    ReplyDelete