বাক্‌ ১৫০ ।। রঙ্গন রায়


 

নতুন পৃথিবী

 

ডিমের কুসুমের মতো নরম আলো নেমে আসছে। আদম চোখ খুলল হাত দিয়ে  কচলাল একটু। অসীম আকাশে নীল রং তার শরীরে নেমে আসছে। সে ধীরে ধীরে উঠে বসল আড় ভাঙল পাশ ফিরতে গিয়েই দেখল সে যেখানে শুয়ে আছে তার পাশেই ধুধু জল। সমুদ্র। এবার চট করে উঠে দাঁড়াল সে। ওপাশ ফিরল সেদিকে বালির রাশি আর তারপরই শুরু হয়েছে ঘন সবুজ জঙ্গল। চারিদিকে মায়াবি আলোটা বড় নরম। মিষ্টি আলোটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। আকাশ সমুদ্র যেখানে একে অপরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে সেদিকে একটা ছোট্ট বিন্দু দেখা যাচ্ছে। টুকটুকে লাল বিন্দু। আদম তার ফর্সা শরীরের দিকে তাকাল বালি লেগে আছে। হাত দিয়ে গা হাত পা ঝাড়ল সে। মাথার চুলে হাত বুলোলো তারপর প্রথম পা ফেলল সমুদ্রের দিকে। আলোর বিন্দুটা যেন এক লাফে একটু উপরে উঠে পড়েছে। লাল লাল আলো লাগছে গায়ে। আদম তাকিয়ে থাকল আদিগন্ত নীল রঙের মধ্যে সদ্য জেগে ওঠা লাল রংটার দিকে। যেন একটা পিংপং বল। বলটা বড় হচ্ছে। জলের মধ্যে চিকচিক করছে কাঁচা সোনার মতো

আদম অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মধ্যে পা ভেজাল আঁজলা ভরে জল নিয়ে ছিটিয়ে দিল আকাশের দিকে।

 

ঈশ্বর এদন বাগানে পায়চারী করছিলেন। গত কয়েকদিন টানা পরিশ্রম করে ক্লান্ত তিনি। এখন কয়েকদিন বিশ্রাম নেবেন। বাগানটি তিনি মনের মতো করে বানিয়েছেন। এত সুন্দর যেন কোনো শিল্পী তুলি দিয়ে একটু একটু করে এঁকেছে। নিজের সৃষ্টির ওপর নিজেরই নজর লেগে যাচ্ছে। তিনি একটু লজ্জা পেলেন। এগিয়ে গিয়ে নারকেল গাছের তলে দাঁড়ালেন। ভীষণ জলতৃষ্ণা পেয়েছে। গাছতলায় কয়েকটা নারকেল পড়ে আছে এদিক-ওদিক। ঈশ্বর ঝুঁকে বসে একটা নারকেল তুলে নিলেন। ঝাঁকিয়ে দেখলেন ভেতরে জল রয়েছে কিনা। তারপর ভেঙে জল পান করলেন। কী মিষ্টি জলটা! প্রাণ জুড়িয়ে গেল তাঁর।

আরাম! ভীষণ আরাম!

তিনি এবার একটা পাথরের ওপর বসলেন। ভাবলেন গতকালের কথা। আদমকে তিনি গতকালই সৃষ্টি করেছেন। নিখুঁত তাঁর মতোই দেখতে হয়েছে। লম্বা, ফর্সা, স্বাস্থ্যবান। ছেলেটি কি আজ জেগে উঠেছে? আজ থেকেই তো তার জীবন শুরু হওয়ার কথা! এই নতুন পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার চেয়েছিলেন তিনি।

নাহ! আর বেশি কিছু চিন্তা করবেন না। এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

নরম ঘাসে পা ফেলে ঈশ্বর তার অনিন্দ্যসুন্দর শ্বেতপাথরের তৈরি প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন।

 

আদম ছুটছে। সমুদ্রের তীর ধরে জলের পাশে পাশে সে ছুটে চলেছে। ঠান্ডা হাওয়া লাগছে গায়ে। ভালো লাগছে তার। বেশ কিছুটা দৌড়নোর পর হাঁপিয়ে গেল সে। থেমে নিয়ে হাত দুটো দুই হাঁটুতে রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। তারপর সেখানেই শুয়ে পড়ল অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগছে। মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে বের হল তার। ভালো। এসবই ভালো।

গায়ে সূর্যের আলো এসে লাগছে। এখন বেশ চড়া আলো। যত সময় যাচ্ছে আলো আরও জোরালো হচ্ছে। আকাশে তুলোর মতো ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। তাকিয়ে তাকিয়ে মেঘের বিভিন্ন আকৃতি দেখতে লাগল আদম। একটা মেঘ অনেকটা দূরের সবুজ গাছগুলোর মতো

তাই তো! ওই জঙ্গলের দিকটা তো এখনও দেখেনি সে! দেখতে হবে। এই সমস্ত দৃশ্যের ভেতর নিজেকে পৌঁছে দিতে হবে।

আদম উঠে দাঁড়াল তার নগ্ন শরীর গ্রিক ভাস্কর্যের মতো সুন্দর। সুগঠিত পা ফেলে ফেলে বালির তীর থেকে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হল সে।

টু টুট টু! টু টুট টু!

কী একটা পাখি ডাকছে। পায়ের খসখস শব্দ আর সমুদ্রের শব্দ ছাড়া এই মিষ্টি শব্দটা কানে আসছে আদমের। প্রবল কৌতুহলে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

প্রথম গাছটির তলে দাঁড়াতেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল তার। এখানে রোদ লাগছে না। জঙ্গলের ভেতরটা কেমন যেন রহস্যময় হয়ে আছে। গাঢ় সবুজ রঙের ভেতর থেকে অনেক রকম শব্দ ভেসে আসছে। কোনোটা পাখি, কোনোটা জঙ্গলের কীটপতঙ্গ। কোনোটা বা হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ে ওঠার শব্দ।

বনের ভেতরে চলে গেল সে। নাহ! এখানে গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। আর একটু কি যাবে সে? এমন সময় এক পাল হরিণ ছুটে বেরিয়ে এল জঙ্গলের ভেতর থেকে। কয়েক পলক তাকিয়ে দেখল আদমকে। তারপর আবার ছুটে বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। ভয় পেয়ে গেল আদম। সে ভেবেছিল সে ছাড়া আর কেউ দৌড়তে পারে না। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না। ওগুলো কী জিনিস?

আদম ছুটে বেরিয়ে এল বন থেকে। আবার আদিগন্ত সমুদ্র। খানিক দূরে একটা উঁচু ঢিপির মতো দেখা যাচ্ছে। ওটার ওপর উঠলে কেমন হয়?

ভাবামাত্রই ছুটল সে। এদিকে সূর্য ততক্ষণে আকাশের মধ্যললাটে উঠে এসেছে। এখন বেশ গরম লাগছে তার। তবুও একছুটে সে ঢিপির সামনে এসে থামল ঢিপির এক পাশে সমুদ্রের ঢেউ অবিরাম এসে আছড়ে পড়ছে। কি ভীষণ শব্দ! আদমের গা দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। ঢিপির গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠতে শুরু করল সে। তরতর করে যখন সে উপরে উঠে দাঁড়াল তখন বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলো আদম। কী বিশাল সমুদ্র আর জঙ্গল। সব দেখা যায় এখান থেকে। সব।

ঝুঁকে পড়ে জলের আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে তার। ভাগ্যিস এই ঢিপিটা চোখে পড়েছিল!

এমন সময় আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হল। ঘন কালো মেঘ। এবং কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামতে শুরু করল ঝমঝমিয়ে।

আকাশ থেকে জল পড়ছে দেখে আদম ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে তো কিছুক্ষণ আগে যখন লাল বিন্দুটা সদ্য জেগে উঠেছে তখন এরকমই জল হাতে করে ছিটিয়েছিল! তাহলে এখন কে ছেটাচ্ছে? তাহলে কি তার চেয়েও বড় কোনো মানুষ আছে? আবার ভয় পেল আদম। ভীষণ ভয়।

সে জানে না এরপর থেকে মানুষ নামক প্রাণীটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শুধু ভয়ই পেয়ে যাবে।

 

বিকেলের দিকে ঈশ্বর প্রাসাদ থেকে বের হলেন। আদমের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। কেমন কাটাল সে সারাদিন সেটা জানা প্রয়োজন। এদন বাগান ছাড়িয়ে ঈশ্বরের ঘোড়া সমুদ্রের দিকে রওনা দিল যেখানে তিনি গতকাল আদমকে তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন, গন্তব্য সেই স্থান।

ঘোড়ায় বসে থেকেও ঝাঁকুনিতে তাঁর মনে হচ্ছে এবার বয়স হয়ে গেছে। আর পারছেন না তিনি। শরীর নামক যন্ত্রটি আর চলবে না। কিন্তু তার আগে আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো করে ফেলতে হবে। খুব শীঘ্রই করে ফেলতে হবে।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দেখলেন সেখানে আদম কেন কোনো প্রাণীই নেই। অবাক হলেন না তিনি। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় যে স্বাধীন প্রাণী কখনওই এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। কিন্তু তাঁর পক্ষে এখন আদমকে খুঁজে বের করা বেশ কষ্টের কাজ। তবে তিনি এটাও জানেন যে রাত হলে আদমকে এখানে কীভাবে নিয়ে আসতে হয়। এখনই তার প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি। আপাতত সূর্যাস্তের রূপ আহরণ করা যাক।

ঈশ্বর ঘোড়া থেকে নামলেন। কিঞ্চিত সামনের বালুচরে এগিয়ে গেলেন। দূরে লাল সূর্যটা মুহুর্মুহু রং বদলাচ্ছে। সারা আকাশ জুড়ে যেন কেউ তুলির বিভিন্ন রং গুলে দিচ্ছে। শিল্পীর হাতে এখন এক দণ্ডও সময় নেই।

সূর্য ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হয়ে গেল লাল রং নিষ্প্রভ হতে হতে এক সময় টুপ করে ডুবে গেল অতল জলরাশির সীমানায়।

ঈশ্বরের হঠাৎ চোখে জল চলে এল আবার দীর্ঘ রাতের আগে সূর্য দেখা যাবে না। আরও একটা দিন পেরিয়ে গেল এভাবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দিন পার হতে থাকবে যেমন আগে...

 

জলের ছায়ায় নিজেকে দেখেছিল আদম। এখন তার মতোই দেখতে আর-কটি মানুষ দেখে অবাক হল সে। আবার ভালোও লাগলো। লোকটা কালো আকাশের সাদা বলটার দিকে তাকিয়ে আছে। চারিদিকে এখন নীল নীল আলো। রহস্যময় পরিবেশ। সমুদ্রের ফেনায় চিকচিক করছে আলোটা। আদম লোকটার দিকে এগিয়ে গেল

ঈশ্বর বললেন, কেমন কাটালে আদম? এই নতুন পৃথিবী কেমন লাগছে?

আদমের হঠাৎ মাথার ভেতর একটা ছবি ভেসে উঠল যেন হাজার আলোর বিস্ফোরণ ঘটছে। আর এরকমই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীর শেষ চিৎকার করছে। ভীষণ শব্দ। মাটি দুলছে। আহ!

আদম বলল, আপনি কে?

আমি তোমার বন্ধু। তোমারই মতো কেউ। তুমি কি আমায় ভয় পাচ্ছ?

না।

তাহলে?

আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন?

ঈশ্বর বুঝলেন। মানুষ কেন, সমস্ত প্রাণীকূল একা থাকতে পারে না। সে চায় তারই মতো একজন তার সঙ্গে থাকুক।

না থাকতে তো পারব না? কেন বলো তো?

আদম শিশুর মতো বলে উঠল, এই সবই খুব ভালো, কিন্তু কখনও কখনও ভয় লাগে।

ঈশ্বর মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, যখন আবার সকালে লাল বিন্দুটা জেগে উঠবে আকাশ সমুদ্রের সীমানায় তখন তোমার মানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। তুমি সকালে যেখানে শুয়েছিলে সেখানেই শুয়ে থাকো।

বলে ঈশ্বর ঘোড়ায় উঠে পড়লেন। আদম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল লোকটা জ্যোৎস্নার আলোয় দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সকালের আলো থাকলে সে নিশ্চিত মানুষটির পেছন পেছন যেত

নিজের মতো একজনকে ভালো লেগেছে তার।

 

ইভ চোখ খুলল চারিদিকে স্নিগ্ধ একটা আলো এসে পড়েছে। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। সোনালি চুলের মধ্যে আলো এসে লাগছে। আড় ভাঙল ইভ। একপাশে অসীম জলরাশি। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইল সেদিকে কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াল পেছনে সবুজ রং। সামনে অসীম নীল। সময় ব্রাহ্ম মূহুর্ত। এমন সময় সে দেখল কে একজন হেঁটে আসছে তার দিকে। ঠিক তখনই মাথার ভেতর ঝলক দিয়ে উঠল একটা দৃশ্য। একজনের হাত ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে প্রচণ্ড আলোর বিস্ফোরণ। হাজার হাজার মানুষ পৃথিবীর শেষ চিৎকার করছে। ভীষণ শব্দ। মাটি দুলছে। আহ!

 

আদম ইভকে দেখছে। ইভ আদমকে দেখছে। দু’জনেই লক্ষ করল দু’জনের নগ্ন শরীর এক রকম। কিন্তু একই রকম নয়। আদম এবার হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। আশ্চর্য! ইভেরও হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছে। সেও হাত বাড়াল পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করল যেন লক্ষ কোটি বিদ্যুৎ বয়ে গেল একে অপরের শরীরের ভেতর। ইভের হঠাৎ হাসি পেল আদমও হাসল প্রশান্তির হাসি। ভালো। এসবই ভীষণ ভালো।

ঈশ্বর তাঁর প্রাসাদে বসে দেখছেন আদম ইভকে। তাঁর ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে। আদম প্রবল কৌতূহলে সমুদ্রের ধারের সেই ঢিপির মাটি খুঁড়ছে। পেছনে ইভ দাঁড়িয়ে আছে।

আদমের হাতে একটা শক্ত চারকোনা জিনিসের ছোঁয়া লাগল আরও কৌতূহলি হয়ে পড়ল সে। পরিশ্রমে তার পিঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপাল থেকেও গড়িয়ে পড়ছে। এবার ইভও হাত লাগাল দু’জনে মিলে আর-কটু খুঁড়তেই জিনিসটা বেরিয়ে এল মোটা শক্ত একটা জিনিস। হাতে ধরা যাচ্ছে। জিনিসটা বের করতে পেরে আদমের ভীষণ আনন্দ হল তার চেয়েও আনন্দ হল জিনিসটা স্পর্শ করে। কেন হল সে জানে না। ইভ এগিয়ে এসে জিনিসটা হাতে নিল দু’জনের মুখেই হাসি। ভালোলাগার হাসি।

ঈশ্বরের মুখেও হাসি। পরিশ্রমের ফল হাতে পেলে মানুষ সবচেয়ে খুশি হয়। তো পৃথিবীর ইতিহাস। এবং এটাই ভবিষ্যৎ। ঈশ্বর তাঁর কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখলেন আদম ইভ যে জিনিসটা খুঁজে পেয়েছে তা গত পৃথিবীর ধ্বংসকারী মানুষেরই অমূল্য সৃষ্টি।

বই।

No comments:

Post a Comment