বাক্‌ ১৫০ ।। অনুপম বলছি


 

হারুকি মুরাকামি কী লিখছেন, মিলান কুন্দেরা কী লিখেছেন, সেসব দিয়ে আমাদের সাহিত্যের বিচার হওয়া উচিত নয়। ওঁরা কোনোকালে মঙ্গলকাব্য পড়েননি, চরিতামৃত পড়েননি, কথামৃত পড়েননি, বিষাদসিন্ধু পড়েননি। ওঁদের লেখার জাত (হ্যাঁ, জাত) আমাদের লেখার জাতের সঙ্গে মিলতেই পারে না। যদি মিলে যায়, আমাদের কোনো লেখকের লেখার সঙ্গে যদি দেখা যায় ওরহান পামুকের বেশ মিল আছে, মুরাকামির লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর লেখা পড়ে, বুঝতে হবে সেটা ম্লেচ্ছ সাহিত্য। ম্লেচ্ছ সাহিত্য আন্তর্জাতিক সাহিত্য নয়। আন্তর্জাতিক সাহিত্য তখন হবে, যখন আমাদের কোনো লেখক বিশ্বসাহিত্যে এমন কিছু যোগ করতে পারবেন, যার ফলে পৃথিবী নড়েচড়ে উঠবে। সেটা অনুকরণ, অনুসরণ বা নকলনবিসির দ্বারা হওয়ার নয়। যে বাঙালি লেখক শিবপুরাণ পড়েননি, তাঁকে আমি সন্দেহ করি। 'কাফকা অন দ্য শোর' না পড়েও আন্তর্জাতিক সাহিত্য লেখা যায়, কিন্তু 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' যে পড়েনি, সে বাঙালি সাহিত্যিকই নয়, আন্তর্জাতিক তো দূরের কথা।

বাঙালি আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়তে তবু পারে, কিন্তু, আন্তর্জাতিক সাহিত্য করতে ভয় পায়। সে হারুকি মুরাকামির গল্প-উপন্যাস পড়তে পারে। যেসব গল্প-উপন্যাসে মেয়েরা ছেলেদের শিশ্ন চুষে দ্যায়, হাতে স্পার্ম নিয়ে খেলা করে, ছেলেরা হস্তমৈথুন নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে। মুরাকামি যখন এসব লেখেন, বাঙালি সহ্য করে নেয়। কারণ জাপান হল বিদেশ। আর এ দেশ? এ দেশে মেয়েরা সতীত্বের পরাকাষ্ঠা। প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে তাদের সফটকোর যৌনতা চলে। কিন্তু সেক্সের অকৃত্রিম স্বাভাবিক রূপ এ দেশ সহ্য করতে পারে না আজও। তাই বাঙালির সাহিত্যও এদেশি হয়ে আছে, আন্তর্জাতিক হয়নি। এবার বলবেন সেক্স ছাড়া কি আন্তর্জাতিক হয় না? না ডিয়ার, হয় না। ওটা জীবনদেবতার নৈবেদ্য। ওটা প্রাণশক্তির উৎস্রোত। ওটা বাদ দিলে আপনি নেই, আমি নেই, সাহিত্যও নেই।

         লেখালেখির জায়গাটা এখন একরকম স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে। যত দুর্দান্ত উপন্যাস কেউ লিখুক, যত স্বর্গীয় কবিতা কেউ লিখুক, এখন আর পাঠক অবাক হবে না। সবাই তো একরকম লিখতে পারে আজকাল। কেউ একটু বেশি ভাল লেখে, কেউ একটু কম ভাল, কেউ হয়ত বেশ খারাপ। কারও বানান ভুল হয়, কারও হয় না। কেউ ছন্দটা জানে, কেউ জানে না। লিখতে মোটের উপর সবাই পারে। কেউ যদি তার মধ্যে দারুণ কিছু লিখে ফেলে, অন্যদের তাতে কি সুবিধা হয় কিছু? অসুবিধাই হয়। কারণ স্ট্যান্ডার্ডটা হাই হয়ে যায়। সেটাকে অ্যাচিভ করার জন্য অতিরিক্ত খাটতে হয়, চুরি-টুরিও করতে হতে পারে। পাঠক তো নেই। সবাই লেখক। কেউ কেউ হয়ত অলসতার কারণে, বা লোকলজ্জার কারণে লেখে না, কিন্তু মনে মনে সেও লেখক। এমতাবস্থায়, সিরিয়াস লেখালেখির খুব সংকট। প্রথম কথা কিছু লোক সিরিয়াস লেখাকে আঁতলামি বলে উড়িয়ে দেওয়ার রাস্তাটা চেপে ধরে আছে, আর কিছু লোক সিরিয়াস লেখার কাছে গেলেই তাদের ঘুম পেয়ে যায়। সবাই লেখক। কেউ জেগে থাকা লেখক, কেউ ঘুমন্ত লেখক। তুমি বানচোদ ভাল লিখছ, তাতে আমার কী? আমার লেখাও কি কিছু কম যায়! সেই অমলদা আমার লেখা পড়ে বলেছে একদিন আমিও বঙ্কিম পুরস্কার পাবো।

বাংলা প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলুন তো? ভাল লেখক পাওয়া? না। আমাদের ভাষায় এই মুহূর্তে যে সংখ্যক ভাল লেখক আছেন, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। ভাল উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ পাওয়া? না। আমাদের ভাষায় এই মুহূর্তে খুবই উচ্চমানের লেখালেখি হচ্ছে, এবং একজন প্রকাশক চাইলেই খুব ভাল উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ পেয়ে যাবেন, এমন কি সেটার জন্য অনেক লেখক পারিশ্রমিকও চাইবেন না, প্রকাশকের টাকায় বইটা হলেই তাঁরা সুখী হবেন। প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল পাঠকের কাছে যাওয়া।

এই যে আনন্দ বা দে'জ এই মুহূর্তে এত নামকরা, পাঠক তো বই বলতেই আনন্দ বা দে'জ বোঝে, এটা কেন? তারা বাংলা সাহিত্যের সেরা বইগুলো করছে? তাদের তালিকাতেই বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকরা আছেন? মোটেই না। তাদের তালিকায় কিছু খুবই ভাল বই অবশ্যই আছে। কিন্তু এমন নয় সেই বইগুলোই তাদের কাঙ্ক্ষিত অ্যাসেট।

কিন্তু বাংলার প্রকৃত সাহিত্য ছোট প্রকাশনাগুলো থেকেই বেরোচ্ছে। এই যে বললাম 'ছোট প্রকাশনা', সেটা কেন বললাম? ছোট প্রকাশনায় খারাপ বই হয়? তাদের লেখকরা প্রতিভাবান নন? মোটেই সেটা নয়। ছোট প্রকাশনাগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না সমাজের বৃহত্তম অংশটার কাছে যাওয়া। অথচ তাদের তালিকাতেই এই মুহূর্তে বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকরা আছেন, বাংলার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কাব্যগ্রন্থ তারাই প্রকাশ করছে। কিন্তু তাদের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা নেই, তাদের প্রচারের উদ্যম নেই সাধ্যও নেই। লেখকের বই তারা করে লেখকের পাঠকসংখ্যার উপরে নির্ভর করে।

অখাদ্য লেখকের বই বিক্রি হয় এবং সেটার জন্য ভাবতে হয় না, কারণ তাঁকে বহন করার দায় নিয়েছে বড় প্রকাশনা। সেই প্রকাশনা বড় কেন? কারণ তাদের ডিস্ট্রিবিউশন আছে, প্রচার আছে, মনোপলি আছে, পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। ওই প্রকাশনা থেকে বই বেরোচ্ছে শুনলেই ক্রেতারা বিশ্বাস করে যে সেই বইটা কেনা যায়। আপনার একটা উপন্যাস কেনার আগে ক্রেতা সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটা খুঁজবে। এখানে আমি কিন্তু 'ক্রেতা' বললাম, 'পাঠক' বললাম না। কারণ বইও একটা বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী, আগে তাকে কেনা হয়, তারপর পড়া হয়। আমাদের সাহিত্য জগতে সেলিব্রিটি আর সেলেবেলিটি শব্দদুটো নিয়েই যত জট।

আপনার যারা পাঠক তারা আপনার বই কিনবেই, কিন্তু আপনার ক্রেতা কই? সেইসব লোক কোথায় যারা কেবল কেনার জন্য আপনার বই কিনবে, পড়ার জন্য নয়? তেমন লোক কি আপনি চান? চান না। লেখককে কি কেউ কিনতে পারে? হ্যাঁ, তার বই কিনতে পারে। কেবলমাত্র পড়ার জন্য।

 

                                           অনুপম মুখোপাধ্যায়

                                           পরিচালক- বাক্‌ অনলাইন